ইসলামের ইতিহাসের ঘৃনিত ফেরাউনের ইংরেজি নাম রামসিস-টু। ইনি প্রাচীন ইতিহাসের ফারাও সম্প্রদায়ের তৃতীয় রাজা। যিনি প্রায় নব্বুই বছর বেঁচে ছিলেন। শেষ বয়সে দাঁত, মেরুদন্ডের সমস্যায় ভুগছিলেন ফারাও রাজা।
কোরানে আছে মুসা নবী তথা হযরত মুসা’র (আঃ) সঙ্গে দ্বন্দ্বে আল্লাহর ইচ্ছায় লোহিত সাগরে ডুবে প্রান হারান ফেরাউন। মুসা নবী তাকে আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করতে বলেছিলেন। কিন্তু ফেরাউন তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সেই শাস্তি পান।
আবার এই ইতিহাস বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বিভিন্নভাবে লেখা হয়েছে। বাইবেলে মুসা নবীর নাম মোসেফ। সেখানে রামসিস টু’র সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় মোসেফের। খ্রিস্টের জন্মের ১৩০৩ বছর আগে এই রামসিস টু তথা ফেরাউনের জন্ম হয়।
ইতিহাসে তাকে রামসিস দ্য গ্রেট বলার কারন আজকের পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের নানাকিছুর গোড়াপত্তন হয় তার হাতে। মিশরে যে পৃথিবীর প্রথম নগর সভ্যতা, কৃষি, টেক্সটাইলের গোড়াপত্তন হয় এসব ফারাও রাজাদের মাধ্যমে মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল।
যার চূড়ান্ত বিকাশ হয় ফেরাউনের হাতে। তার আমলে তিনি ফসলের বুনন ও সংগ্রহ উপলক্ষেও তিনি আলাদা উৎসব চালু করেছিলেন। তার দাঁতের সমস্যার আধুনিক চিকিৎসার প্রমান ঐতিহাসিকরা পেয়েছেন।
আর মিশরের পিরামিড যেগুলো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের অন্যতম, এসব নির্মান শৈলীর যোগ্যতা ফারাও রাজারা ফেরাউনের আমলেই অর্জন করে। কায়রো জাদুঘরে ফেরাউন সহ তার শিশুকাল, রানী সহ যে সব মূর্তি আছে সেগুলো পাথর কেটে ফারাও যুগের ভাষ্কর্য শিল্পের দক্ষতার প্রমান।
বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের আমলে এসব মূর্তি ভাঙ্গার চেষ্টাও হয়। সেই মূর্তিগুলো ভাঙ্গা অবস্থাতেই কায়রো জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
মৃত্যুর পর ফেরাউনের মমি ও সমাধির বর্ননা আছে কোন কোন ইতিহাসে। আবার বলা হয়েছে তার পরিনতি পরবর্তী পৃথিবীর অবিশ্বাসীদের মনে করিয়ে দিতে তার মরদেহ পাথর করে রাখা হয়।
তার বর্তমান মমিটি ১৮৮১ সালে আবিষ্কৃত হয়। রানী নেফাত্রি/নেফারট্রি ছিলেন রামসিস-টু’র সবচেয়ে আলোচিত স্ত্রী। মিশরীয় উচ্চারনে এই রানীর নাম এমন বিভিন্ন হয়। তার সৌন্দর্য্যের কারনে তিনি বিশেষ আলোচিত ছিলেন।
এই রানীর মমি-সমাধির রত্মরাজি বিভিন্ন সময়ে লুটতরাজের শিকার হয়। রানীর নানা রকম মূর্তি, স্যুভেনুর মিশরের পর্যটন শিল্পের অন্যতম প্রধান বিক্রিত পণ্য।
পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মতো লম্বা ছিলেন ফেরাউন। তার মমিতে তার চুল, ভ্রুর বেশ কিছু অবিকল অবিকৃত টিকে আছে। নব্বুই বছর বয়সে মৃত্যুর সময় চুলগুলো খুব স্বাভাবিক সাদা হয়ে গিয়েছিল।
বাদামী শরীরের চামড়ার রঙের নানা অংশে কালচে দাগ পড়ে যায় মমিতে। তার মুখের অবশিষ্ট আদলে মৃত্যুর আগে বয়সী রাজার মুখের আদল সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাচ্ছিল।
প্যারিসের পরীক্ষায় ধারনা পাওয়া গেছে জীবিত ফেরাউনের চুল ছিল লাল রঙের। তার দাঁতে ইনফেকশন ছিল। জীবনের শেষ দিনগুলোয় হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়ায় বিশেষ কিছু ব্যবস্থার সাহায্য নিতেন।
আমি যখন মিশর যাই তখন আজকের মতো অনলাইন ছিলোনা। ফেরাউনের মমির ছবি তোলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আমি সাংবাদিক। আমার লেখার জন্যে দরকার ছিল সেই ছবি। সাংবাদিক নিউজের প্রয়োজনে সোর্সকে টাকায় কেনে।
আমিও সে দিন তেমন একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলামসে কক্ষের প্রহরায় থাকা পুলিশ সদস্যকে বললাম আমি একজন সাহাফি(সাংবাদিক), তোমাদের দেশ দেখতে এসেছি। ফেরাউনের ছবিটা আমার তোলা লাগবে।
তোমাকে এরজন্যে আমি ষাট পাউন্ড দেবো। বোঝা গেলো পুলিশের সেই সদস্যকে আমি জয় করতে পেরেছি। তিনি আমাকে বললেন এ কক্ষটা বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়।
আমি সাড়ে চারটার দিকে গেলে তিনি আমাকে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেবেন। ঘুষগ্রহিতা কথা রেখেছিলেন। কথামতো সাড়ে চারটায় সেখানে গেলে সময় শেষ সময় শেষ বলের কক্ষের দর্শনার্থীদের বের করে দেন সেই পুলিশ সদস্য।
আমি টপাটপ বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলি ফেরাউনের মমির। ষাট পাউন্ড পেয়ে মিশরীয় পুলিশের সেই সদস্যকে তখন বিজয়ী দেখাচ্ছিল! কারন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্ররা তখন মাসে পয়ষট্টি পাউন্ড বৃত্তির টাকায় পড়তেন।
আর আমার বিজয় আমি ফেরাউনের মমির ছবি সংগ্রহ করতে পেরেছি। বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর আমার আত্মীয়স্বজনরা সম্ভবত আমার কাছে প্রথম ফেরাউনের মমির ছবি দেখেন। তারা সেটি আগ্রহভরে দেখতেন।
এরপর আবার ধর্মীয় বিপদ যাতে না হয় সে ধারনায় নাউজুবিল্লাহও বলে নিতেন। এই মমি কায়রো জাদুঘরে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার মধ্যে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ১৯০১ সালে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এখন যে মমিটি কায়রো জাদুঘরে আছে সেটি ফেরাউনের আসল অবস্থার মমি নয়।
১৯৭৫ সালে ফ্রান্সের একজন ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন দূর্বল অবস্থার কারনে প্রত্মতাত্ত্বিক মূল্যবান নিদর্শন ফেরাউনের মমিটি দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তার রিপোর্টের ভিত্তিতে ফ্রান্সের প্রত্মতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা এটির সংরক্ষনে এগিয়ে আসেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মিশর সরকারকে এ নিয়ে আলোচনায় রাজি করাতে পারলে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে এটিকে প্যারিসে নেয়া হয়। ফেরাউনের মমিকে ফ্রান্সে একজন রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় সামরিক স্যালুট জানানো হয়।
এরজন্যে ফেরাউন তথা রামসিস-টু’র নামে ইস্যু করা হয় মিশরীয় পাসপোর্ট। পাসপোর্টে তার পেশা লেখা হয় সাবেক রাজা। মিশরে ফেরাউনের আইনগত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে তখন তাকে দেয়া হয় মিশরের নাগরিকত্ব।
পাসপোর্টের জন্যে মমি থেকে তোলা হয় ফেরাউন রাজার মুখের নানা রকম ছবি। প্যারিসের ল্যাবরেটরিতে মমিটির নানান রাসায়নিক পরীক্ষা হয়। তখন জানা যায় মমির চুল, ভ্রু, বাদামী চামড়ার কিছুটা এসব অরিজিন্যাল।
এত সহস্র বছর তা টিকে আছে দেখে মমি বিজ্ঞানীরা চমৎকৃত হন। রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা যায় যৌবনে লাল ছিল ফেরাউনের চুল। এতে ধারনা হয় লাল চুলের কোন পরিবার থেকে জন্ম হয়েছিল ফেরাউনের।
প্রাচীন মিশরে লাল চুলের অনেক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল এমন প্রমানও পাওয়া গেছে। রাসায়নিক পরীক্ষা বলেছে, কোন এক যুদ্ধে আঘাতের স্মৃতি ফেরাউনের হাড়ে পুরনো ফ্র্যাকচারের প্রমান পাওয়া গেছে।
শেষ বয়সে ইনফেকশন জনিত দাঁতের সমস্যা, মেরুদন্ডের ব্যথায়ও কষ্টে কেটেছে এই ফারাও রাজার। প্যারিসের গবেষনাগারে মমিটি নেয়া না হলে হয়তো এসবের বিস্তারিত এভাবে জানাই যেতোনা।
প্যারিস থেকেই এই মমি সংরক্ষনের যাবতীয় ফর্মূলা বাতলে দেয়া হয় মিশর জাদুঘরকে। সেভাবে ফেরাউনের মমি আছে এখন কায়রো জাদুঘরে। ১৯৭৭ সালের মে মাসে প্যারিস থেকে ফিরে আসার পর ফেরাউন আর বিদেশ যাননি।