সেই লায়লা বলেছিলেন শখ করেতো কেউ শরণার্থী হয়না ভাই

আমি ফিলিস্তিনে যাবো। শাহতা জারাবের একটা চিঠি আমার পকেটে। শাহতা জারাব তখনকার বাংলাদেশের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত। আমাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। আমাকে ফিলিস্তিন নিয়ে যাবার জন্যে পিএলও তথা প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার কায়রো ও আম্মান মিশনকে তিনি চিঠি লিখে দিয়েছেন।

শাহতা জারাব চিঠিতে কী লিখেছেন তা অবশ্য জানিনা। কারন চিঠি লেখা হয়েছে আরবিতে। প্রতিদিন এ চিঠি নিয়ে একবার পিএলও’র আম্মান অফিসে আসি। প্রথম দিন আসল চিঠিটা তাদের কাছে জমা দিয়েছি।

ফটোকপি কয়েকটা পকেটে রেখেদিলাম। এর একটা হাতে প্রতিদিন সে অফিসে গেলে অফিস কর্মকর্তা যার দেখা পাই তিনি আহলান ওয়াসসাহলান বলে বুকে জড়িয়ে ধরে বসান। ছোট কাপে কড়া চা-কফি খেতে দেন।

জিজ্ঞেস করেন সীসা খাব কীনা। বাংলাদেশের সিনেমার রাজা-বাদশাদের বাড়ির হেরেমের দৃশ্যে এসব লম্বা পাইপওয়ালা তামাক খাওয়া দেখেছি। কিন্তু আরব দেশেও যে এটি লোকজন খায়, এখানে এর নাম যে সীসা তা আগে জানতামনা।

আরব দেশে আসার পর এদের জীবনাচরনের আরও নানা কিছু দেখে অবাকই হচ্ছিলাম। যেমন এ জাতি খুবই ধুমপায়ী। এদের অনেকে সিগারেট প্যাকেট কেনেনা। কার্টন কার্টন কেনে!

বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা, পরিবারের কর্তা বা ছেলেরা সিগারেট খান বা খাবেন এটাই যেন স্বাভাবিক। ছোটবেলা দেখতাম গ্রামের মায়েরা-মেয়েরা যারা সিগারেট খান, তারা লুকিয়ে লুকিয়ে খান।

কিন্তু এই আরব দেশে এসে দেখি মেয়েদের-মায়েদের এই সিগারেট খাওয়াটা সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্য প্রকাশ্য বিষয়। নানা ব্যবসা-বানিজ্যের কর্তৃ্ত্বেও এখানে মেয়েরা-মায়েরা।

 বিবি খাদিজাও ব্যবসায়ী মহিলা ছিলেন। আর বাংলাদেশের মোল্লা-মৌলভীরা ফতোয়া দিয়ে মহিলাদের ঘরে ঢোকাতে পটু। এদের বুড়োটার আবার মেয়ে-মহিলা দেখলে অক্ষম তেতুঁল তেতুঁল বোধ হয়!

মিশরের গ্রামাঞ্চলের মুসলমান মেয়েরা-মায়েরা লম্বা বোরকা পরলেও শহরাঞ্চলে তাদের সিংহভাগ মাথায় ক্লিপ দিয়ে বাঁধা ওড়না বেঁধে চলতে অভ্যস্ত। এতে তাদের কাজ করতেও সুবিধা হয়।

মুসলিম স্কুল শিক্ষিকা, অফিস কর্মকর্তা, দোকানিরা এমন মোটামুটি বুক পর্যন্ত মার্জিত ঢেকে রাখা ওড়নাতেই বেশি অভ্যস্ত। তাদের হাতে অনেকের জ্বলন্ত সিগারেট, দল বেঁধে একসঙ্গে বসে সীসা খেতে খেতে আড্ডা মারা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

কায়রোর এই পিলও গেলে যাদের সঙ্গে কথা হয় তারা মূলত ফিলিস্তিনি শরণার্থী। নানা রকম চিঠির জন্যে তারা পিএলও অফিসে আসেন। এমন ৫০ হাজারের মতো ফিলিস্তিনি শরণার্থী কায়রোয় থাকি।

এমন দেশান্তরী শরণার্থী ফিলিস্তিনিরা আমি ফিলিস্তিন যেতে চাইছি শুনে অবাক হন। তাদের অনেকে বলেন তারা তাদের দেশে যেতে পারেননা। আর আমি ফিলিস্তিন যেতে চাইছি!

এই কয়েকদিন পিএলওর কায়রো অফিসটায় যেতে যেতে লায়লা নামের এক মেয়ের সঙ্গে অনেকটা চেনা জানা হয়ে গেছে। আরবদের অনেকে থ্যাংকু উচ্চারন করতে পারেনা। বলবে স্যাংকু।

লায়লাকে একদিন কথাটি বলেছিলাম। তখন সেই লায়না বারবার শুধু থ্যাংকু উচ্চারন করে বলেছিলেন, এই দেখেন আমি ফিলিস্তিনি মেয়ে। আমরা থ্যাংকু বলতে পারি। এই লায়লা কায়রোয় থাকা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অন্যতম।

 বললেন তাঁর জন্ম কায়রোয়। কোন দিন ফিলিস্তিন যাননি। লায়লা পড়াশুনা করছিলেন কায়রোর একটি কলেজে। মিশরের বাইরের কোন দেশে বৃত্তি নিয়ে চলে যেতে চান। এরজন্যে শরণার্থী হিসাবে একটি চিঠির জন্যে পিএলও অফিসে ধর্নায় আসেন।

আমাকে বলেন শরণার্থী জীবন মূল্যহীন। এখানে পথেঘাটে রাস্তার ছেলেরা পরিচিত দোকানিরা দেখে টিপ্পনি কাটে। মনে করে এটি শরণার্থী মেয়ে। এরজন্য এর সঙ্গে যা খুশি করা যাবে। অথচ কেউতো শখ করে শরণার্থী হয়না ভাই।

আমার বাবা-মা’ও বাধ্য হয়ে শরণার্থী হয়ে মিশর এসেছিল। বুদ্ধিমান শরণার্থীদের অনেকে এখান থেকে সুবিধামতো বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। বুদ্ধির অভাবে আমার বাবা-মা সেটা পারেনি।

  সে জন্যে আমি এমন কোন দেশে চলে যাবার চেষ্টা করছি যেখানে মানুষ অন্তত আমাকে শরণার্থী হিসাবে চিনবেনা। এই লায়লার কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছিল।

এরপর থেকে যখনই যেখানে শরণার্থী দেখি বা তাদের কাহিনী পড়ি, আমার এই লায়লার কথা মনে পড়ে। ‘শখ করে কেউ শরণার্থী হয়না’। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যখন বাংলাদেশে আসছিল, যখন সবাই না না করছিল, তখনও আমার লায়লার কথা মনে পড়তো।

 আরব বিশ্বে আমি দেখেছি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সেখানকার সমাজ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের কেউ দেখতে পারেনা। অথচ জুম্মা-ঈদের জামাতে তাদের জন্যে দোয়া করা হয়! মুসলিম নেতারা উম্মাহর বক্তৃতা দেয়!

অথচ পৃথিবীজুড়ে প্রকৃত শরণার্থীদের মধ্যে এখন মুসলমানের সংখ্যা বেশি। তাদের দেশ নেই, রাষ্ট্র নেই। কিন্তু মুসলমান দেশগুলো উম্মাহর কথা বললেও দেশ-রাষ্ট্রহীন মুসলমান শরণার্থীদের গ্রহন করতে চায় না।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যখন আসে ছবি তুলতে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কভারেজ পেতে ছুটে এসেছিল তুরস্কের ফার্স্টলেডি! কিন্তু একজন রোহিঙ্গাকেও নিয়ে যায়নি।

দিনশেষে বিশ্বজুড়ে এখন অমুসলিম কল্যান রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগ এখন এসব মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। সিরিয়া থেকে ঢলের মতো ঢোকা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে অমুসলিম ইউরোপ।

ওই ঢলের সঙ্গে মিশে চল্লিশ হাজারের বেশি বাংলাদেশিও তখন শরণার্থীর মিথ্যা পরিচয়ে ইউরোপে ঢুকেছে! বাংলাদেশ থেকে নৌকায় করে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের বাংলাদেশ ডিপোর্ট করতে পারেনি।

তাদের কোন বিমানে তুলে দেবে? তাদের যে দেশ নেই, রাষ্ট্র নেই। সৌদি আরব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। কারন সৌদি আরব জানে এরা বাংলাদেশি পাসপোর্টে তার দেশে গেছে।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবস্থা দুর্নীতিবাজ বলে এখানে যে কেউ পাসপোর্ট পায়। অস্ট্রেলিয়াও জানে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। কিন্তু এই দেশ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারেনা।

কারন অস্ট্রেলিয়াও জানে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নয়। এরা প্রকৃত শরণার্থী। এদের দেশ নেই রাষ্ট্র নেই। এই মুসলিম শরণার্থী ইস্যুতেও মুসলিম দেশগুলো বিশ্বকে তাদের জাত জিনিয়েছে।

সেই লায়লা এখন কোথায় আছেন কেমন আছেন তা জানিনা। তার জীবনের হাহাকার নিয়ে বলা সেই কথাগুলো মনে হলে আজও মন খারাপ হয়। ‘শখ করে কেউ শরণার্থী হয়না’।

 পিএলও’র কায়রো অফিস আমার জন্যে কিছু করতে পারছেনা দেখে এক পর্যায়ে আমি সেখানে যাতায়াত বন্ধ করে দেই। তাদের কাছে আমার সমস্যা অযোগ্যতা আমার সবুজ পাসপোর্ট!

কারন ফিলিস্তিনে যাবার সীমান্তের নিয়ন্ত্রন ইসরাইলি সীমান্তরক্ষীদের হাতে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র উন্নত বিশ্বের আরেক প্রতারনার নাম! এর সীমান্ত নিয়ন্ত্রন করে ইসরাইল! সেখানে যাবার ভিসা দেয় ইসরাইল!

কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই তাই পিএলও আমার সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ভিসার জন্যে তাদের কাছে তা নিয়ে যেতেই পারছেনা। খালি আশ্বাস দেয়, চেষ্টা করছি।

অতএব সাহস করে একদিন কায়রোর ইসরাইলি দূতাবাসে চলে গেলাম। মিশর-জর্দানের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক, ব্যবসা-বানিজ্য আছে। তাই এই দুই দেশে ইসরাইলের দূতাবাসও আছে।

এক বহুতল ভবনের মধ্যে সেই দূতাবাস। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ দেখে ভয়ও লাগলো। লোহার ব্যারিকেডের কাউন্টারের ওপাশে বসা দুই ইসরাইলি কর্মকর্তা। ভিসার আবেদনের ফরম চাইতেই আগে দেখতে চাইলো পাসপোর্ট।

বুক পকেট থেকে আমার বাংলাদেশ, সবুজ রঙের পাসপোর্ট বের দিতেই যেনো ওই দুই জন তরুন ইসরাইলির একরকম লাফিয়ে ওঠার অবস্থা! কারন এই রঙের এই পাসপোর্ট যেনো তারা এই প্রথম দেখেছে!

আমাকে সরাসরি তারা না করলোনা। এটিই বুঝি কূটনৈতিক শিষ্টাচার। ভদ্রভাবে বললো, তুমি বরঞ্চ কোন ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে চেষ্টা করো। একজন ট্যুর অপারেটরের নাম্বার দিয়ে যেনো আপদ বিদায় করলো!

সেই ট্যুর অপারেটরকে ফোন করতেই বাংলাদেশি পাসপোর্টের কথা শুনে সে বললো, বুঝলেনা, তোমাকে ডাইরেক্ট না বলতে না পেরে আমার নাম্বার দিয়েছে। দূঃখিত ভাই।

মিশরের এসব ট্যুর অপারেটররা মূলত যে সব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এমন দেশের পর্যটকদের আল আকসা মসজিদ, বেথলহেম এসব দেখাতে  সে সব ভেন্যুতে নিয়ে যান।

তাদের ট্যুরিস্ট তালিকা-ট্যুর প্ল্যানের সবকিছু আগে ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ থেকে পাশ করাতে হয়।

কায়রোর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যখন শুনলেন আমি ভিসার জন্যে ইসরাইলি দূতাবাসে গিয়েছিলাম তিনিতো রেগে আগুন! আমাকে বললেন,  আপনি জানেননা ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, আর আপনি ওখানে গেছেন!

 আমি আপনার ব্যাপারে ঢাকায় রিপোর্ট করবো। ভদ্রলোক শান্ত হতে বললাম, আপনিতো জানেন আমি সাংবাদিক। বেড়াতে নয়। ফিলিস্তিন যাবার জন্যে মিশর এসেছি।

যাবার কোন পথ করতে পারলে ইসরাইলের ভিসা নিয়েইতো সেখানে যেতে হবে। আমার জন্য এ ব্যাপারে আলাদা কোন পথ-ব্যবস্থা নেই। আমার কোন পাখাও নেই। ভদ্রলোক আর কথা বাড়াননি।