কভিড নাইন্টিনের তান্ডব বদলে দিয়েছে পৃথিবীর সব হিসাব-নিকাশ। উন্নত বিশ্বতো বটে, বাংলাদেশের মতো দেশও পড়েছে নানা সমস্যায়। পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা-পরিকল্পনাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে মহামারীর সংক্রমন আর এর মৃত্যু উপত্যকা।
বাংলাদেশের লোকজন যারা এখন এই সমস্যা সেই সমস্যা বলছেন তাদের সিংহভাগ এখনও জানেননা আগামী দশদিন বা একমাস পর তাকে কী বলতে হবে। কাজেই কথা কম বলে যার যার ব্যক্তিগত-পারিবারিক ও সামাজিক সুরক্ষায় মন দেয়া উচিত।
বাংলাদেশের এই যুদ্ধে প্রথম ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন। দেশের দূর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো, প্রস্তুতির অভাব, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবকে এর জন্যে দায়ী করা হয়েছে।
বিপুল সংখ্যায় পুলিশ আক্রান্ত হবার ঘটনা প্রকাশ করেছে এই রাষ্ট্র এতোদিন শুধু তাদের সার্ভিস নিয়েছে। কিন্তু তাদের মানবিক স্বাস্থ্য সম্মত থাকার ব্যবস্থাটিও কখনও করেনি! দেশের মানবিক মানুষেরা এ নিয়ে এখন অনুতপ্ত-ক্ষুদ্ধ।
বাংলাদেশের পুলিশের মানবিক স্বরূপ এই করোনার বিশেষ একটি আবিষ্কারের নাম। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা সারাক্ষন নানা সমালোচনায় বিদ্ধ হয়। কিন্তু দেশের খুব কম মানুষ এখানে সাংবাদিকদের হাড়ির খবর জানেন।
বেতন না পেলে অন্য পেশার লোকজন অফিস করবেননা। কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা যেখানকার লোকজন এসব নিয়ে ভাবতে গেলে এই সময়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতো দেশ।
একটি তথ্য প্রবাহটি এমন যে এটি না থাকলে একটি দেশের আলো জ্বলেনা। ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও প্রতিদিন মিডিয়ার সামনে এসে জবাবদিহি করতে হয়। বাংলাদেশের এই যুদ্ধেও জ্বালিয়ে রেখেছেন সাংবাদিকরা টর্চের আলোটি।
তাদের অনেকে প্রতিদিন না খাওয়া, উপোস অবস্থাতেও কাজে যান। তাদের কাজের কোন সময়সীমা নেই। এমন মানসিকতা ছাড়া কারও পক্ষে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
এই দূর্যোগে রাষ্ট্র দেশের নানান লোকজনকে প্রনোদনা দিলেও মিডিয়ার লোকজনকে সে গোনায় ধরেনি! অতঃপর সাংবাদিক কল্যান ট্রাস্ট থেকে কিছু অনুদান দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের এসব অনুদানের বরাবরের চিন্তাটি মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক। মফঃস্বলের সাংবাদিকদের এই সময়েও এই প্রনোদনার বাইরে রাখলে তা চরম আরেকটি অন্যায় হবে।
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তির নাম রেমিটেন্স। এখানে আবহাওয়া এক মওসুম ভালো না থাকলে নড়বড়ে হয়ে যায় কৃষি অর্থনীতি। গার্মেন্টস মালিকদের মতো দরিদ্র দেশে দ্বিতীয় কোন গোষ্ঠী নেই!
এরজন্যে সরকারকে সব দূর্যোগে সবার আগে দরিদ্র গার্মেন্টস মালিকদের অক্সিজেন দিতে প্রনোদনা ঘোষনা করতে হয়। কিন্তু দেশের যারা বিদেশ যান তাদের ব্যাপারে পরিবার এবং রাষ্ট্রের একটাই কমন দাবি ছিল তারা আনবে আর দিবে।
দেশের এক কোটির বেশি মানুষ এখন বিদেশে থাকেন। এরা শুধু পরিবারের মাসিক বাজার খরচ নয়, পরিবার-স্বজনের শিক্ষা-চিকিৎসা-বিয়ে-মৃত্যু উপলক্ষেও টাকা পাঠান।
রোজায় জাকাত-ফিতরা, পরিবারের-স্বজনের ঈদ করার টাকা, কোরবানির টাকাও পাঠান নিয়মিত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসীদের বড় অংশ থাকেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বিদেশিদের নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ নয়।
তাই তাদের সেখানে বাড়ি-সম্পদ ক্রয় সহজ নয়। তাদের আয়ের সিংহভাগ তারা দেশেই পাঠান। এমন নানাভাবে প্রবাসীদের টাকা দেশে নিয়মিত যায় বলে বরাবর রমরমা থাকে বাংলাদেশের রেমিটেন্সের আয়।
কারন এ জাতির পারিবারিক বন্ধনের সময় প্রবাসীদের টাকা পাঠানো বন্ধ হয়না। এখনতো বিকাশ সহ বিদেশ থেকেও দেশে টাকা পাঠানোর নানান নতুন সহজ মাধ্যম গড়ে উঠেছে। বিকাশ সহ ফোন ব্যাংকিং এর টাকা কী রেমিটেন্সের খাতায় জমা হয়না?
সে কারনে যখন দেশের মিডিয়ায় রেমিটেন্স কম যাবার রিপোর্ট হয় তা আমরা যারা বাইরে থাকি তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়না। কারন বিদেশে আমরা যত সমস্যায় থাকিনা কেনো, দেশে টাকা পাঠানো আমরা বন্ধ করতে পারিনা।
কারন আমাদের মায়েদের আহার-চিকিৎসা-ভালো থাকা যে এ টাকার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই কভিড নাইন্টিন নামের মহামারী আর সবকিছুর মতো বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয়ের নানান হিসাব-নিকাশও লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।
সবচেয়ে করুন সত্য বিদেশ থেকে প্রবাসীদের বেশি বেশি মৃত্যুর খবর আসছে। এমন সব দেশ থেকে খবরগুলো আসছে সেই দেশগুলোর স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক উন্নত ও সুসংগঠিত।
বাংলাদেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি চিকিৎসার জন্যেও এসব দেশে যান। সেখানে বাংলাদেশিদের এত মৃত্যুর কারন কী? এরসঙ্গে দেশে বেশি সংখ্যায় পুলিশের সংক্রমনের ঘটনার মিল আছে।
বাংলাদেশের পুলিশ ব্যারাকগুলোর অস্বাস্থ্যকর থাকার ব্যবস্থার কারনেও অনেক পুলিশ সদস্যের আক্রান্তের কারন। আর মধ্যপ্রাচ্য-সিঙ্গাপুর সহ নানা দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের থাকার ব্যবস্থার কারনেও তারা রোগটায় আক্রান্ত হয়েছেন।
যারা দেশের বিভিন্ন এতিমখানায় গেছেন তারা সেই প্রবাসীদের থাকার জায়গাটি সম্পর্কে ধারনা করতে পারবেন। এতিমখানার ছেলেমেয়েদের এক কক্ষে কয়েকজন রাখতে দ্বিতল-ত্রিতল চৌকির ব্যবস্থা করা হয়।
যে প্রবাসী বিদেশ থেকে ছেলেমেয়েদের নতুন খাট-পালঙ্ক বানানোর টাকা পাঠান, তাদের অনেকে কিন্তু বিদেশে এমন এককক্ষে কয়েকজন থাকেন। আলু ভর্তা-ডাল বা বাজারের সবচেয়ে সস্তা খাবার দিনের পর খেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠান।
কিন্তু এসব ছবি তারা কোনদিন স্বজনের সঙ্গে শেয়ার করেননা। কিন্তু এই করোনায় প্রবাসীদের ব্যাপক আক্রান্তের ঘটনায় সামনে চলে এসেছে আলোর দেশগুলোয় তাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সত্য বাস্তব।
এখন বিশ্বের দেশে দেশে অনেক প্রবাসী চাকরি হারিয়ে বাড়িভাড়া দিতে অসমর্থ হওয়ায় ঘনিষ্ঠজনদের আবাসিক এলাকাগুলোয় উঠে আসায় সেগুলো আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে। এগুলো এখন হয়ে উঠেছে করোনার একেকটি কুঞ্জ!
এসব স্বত্ত্বেও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে প্রবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা কম। কারন সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাটি উন্নত-সংগঠিত। তারা আক্রান্ত সবাইকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়। অনেক দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের চিকিৎসা দেয় শ্রমিকের মতো করে।
এই দূর্যোগে বিশ্বের দেশে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মহামারী রোগটায় ব্যাপক আক্রান্ত হওয়া কাজ হারানোর ঘটনা বাংলাদেশের জন্যেও বড় দূর্যোগের নাম। কারন রেমিটেন্সের আয়ও তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
যারা মারা যাচ্ছেন তাদের পাঠানো সার্ভিসও দেশ আর কোনদিন পাবেনা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেক শ্রমিককে ফেরত পাঠাচ্ছে। তারা দেশের বেকার লোকজনের তালিকাকে আরও দীর্ঘ করবেন।
এতে করে পরিবারগুলো হারাচ্ছে নিরাপদ একটি আয়ের অবলম্বন। অনেকে প্রবাসীদের নানা প্রনোদনা দেবার ফর্মূলা দিচ্ছেন। সরকার দাবি করছে তারা ওখানে সেখানে প্রবাসীদের খাবার-টাকা দিচ্ছে!
যদিও এর একটিও বাস্তব নয়। কয় টাকা দেবেন? প্রবাসীরা টিকে গেলে দেশগুলোর লকডাউন উঠে গেলে যার যার কাজ-অবলম্বন তারা নিজেরাই খুঁজে নেবেন। আবার তাদের পরিবারগুলোয় টাকা পাঠাতে শুরু করবেন।
এটাইতো আমাদের পারিবারিক বন্ধন। এটাইতো আমাদের বাংলাদেশ। এর প্রবাসীদের দেহটা বিদেশে থাকলেও মনটা সারাক্ষন থাকে বাংলাদেশে। কাজেই প্রবাসী আয়টা সবার আগে স্বাভাবিক হবে।
এই করোনায় যে সব প্রবাসী প্রান হারিয়েছেন তাদেরকে শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ তাদের অবদানের কথা ভুলবেনা।