সম্রাট অরেলিয়ানের আক্রমনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা গবেষনা আবিষ্কারের সূতিকাগার আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রাচীন লাইব্রেরিটি পুড়ে গিয়েছিল। আধুনিক মিশর সেটি আবার নতুন করে গড়ার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু প্রাচীনটাতো আর অবিকল করা যায়নি। উদ্ধারও করা যায়নি প্রাচীন ঐতিহ্যের সবকিছু । তবে যতোটা উদ্ধার করা গেছে তাতে পর্যটকদের মনে করিয়ে দেয়া গেছে মিশরের কী ছিল আর এখন কী নেই।
এই মিশরে এই আলেকজান্দ্রিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সময়ের সবচেয়ে প্রাচীন- সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছিল। তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিরা এখানে গবেষনা করতে এসেছিলেন।
এই আলেকজান্দ্রিয়ায় বসে সিদ্ধান্ত হয়েছিল পৃথিবীটা গোল। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুর। এমন অনেক আবষ্কার-সিদ্ধান্ত আলেকজান্দ্রিয়ায় বসে হয়েছে। এখন আলেকজান্দ্রিয়ার নানাকিছু দেখেশুনে আপনি আক্ষেপও করতে পারবেন।
সেই লাইব্রেরির কাহিনী দেখেশুনে আপনি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন মানুষ কিভাবে তার অতীত ধংস করতে পারে। অতীত সৃষ্টি করতে পারেনা। এখানে এখন প্রদর্শনীর মতো করে পর্যটকদের দেখানোর চেষ্টা করা হয় অতীত দিনের সেই লাইব্রেরি।
‘মিউজিয়াম অব এন্টিকিউটিজ’। আলেকজান্দ্রিয়ায় পাওয়া টলেমি ও রোমান আমলের প্রত্মসম্পদের সংগ্রহশালাটি এখানেই। রোমান যুগের এক বালকের একটি ভাষ্কর্য আছে এখানে। বাচ্চাটি কী ক্লান্ত ঝিমুচ্ছে? তা স্পষ্ট নয়।
এমন ছোট বাচ্চারতো আর রাজপ্রাসাদের প্রহরী হবার কথা নয়। চতুর্দশ শতকের ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে বিধবস্ত হয় আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বাতিঘর। যে বিস্ময় বাতিঘর বহুদূর থেকে দেখে নাবিকরা চিনতেন তাদের গন্তব্য।
ওই দেখা যায় আলেকজান্দ্রিয়া! ওখানে রাজত্ব করতেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রানী ক্লিওপ্যাট্রা! তাঁর রাজত্ব আর সুন্দরী রানী যার দখল পেতে যেখানে একের পর এক যুদ্ধ হয়েছে!
ভূমিকম্পে বিধবস্ত বাতিঘরের জায়গায় বানানো হয়েছে কায়েত-বে দূর্গ। কারন কম্পাস আবিষ্কারের পর আর বাতিঘরের দরকার লাগেনি। মামলুক শাসক সুলতান আল আশরাফ ১৪৮০ সালে দূর্গটি নির্মান করেন।
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে যাওয়া যায় এমন একটি শহর আল আলামিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে শহরটি বিখ্যাত। ১৯৪২ সালে এর কাছে জার্মান আর ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় হয়। নাৎসী বাহিনী হেরে যায় মিশরে।
এই যুদ্ধের পর তিউনেসিয়া পর্যন্ত বিতাড়িত হয় নাৎসী বাহিনী। সেই যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধি আছে এই আল আলামিন শহরে। জার্মান, ইতালিয়ান, কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলোর নিহত সৈনিকদের সমাধি আছে আল আলামিনে।
রেড সী’র আরেক নাম লোহিত সাগর। এর দুই পাশে দুই মহাদেশ। এশিয়া-আফ্রিকা। মরুভূমির বালিয়াড়িতে লুকিয়ে আছে অতীত দিনের নানান স্মৃতি। অথবা অতীত দিনের বোবা কান্না।
সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এখানকার সিনাই পেনিনসুলায় করুন সময় গেছে ইহুদি বেদুইনদের! জেরুজালেম পৌঁছার আগ পর্যন্ত মরুভূমিতে পথ হারিয়ে মুসা নবী তথা হযরত মুসা(আঃ) এর নেতৃত্বে তারা পথ হারিয়েছিল!
চল্লিশ বছর মরুভূমির এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে! মুসলমানদের তুর পাহাড়টাই খ্রিস্টানদের কাছে মাউন্ট সিনাই। এই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা সন্ত ক্যাথারিনের মঠকে পৃথিবীর প্রাচীন মঠ বলা হয়।
খ্রিস্টানদের পবিত্র তীর্থ প্রাচীন এই মঠ। একজন খ্রিস্টান সন্নাসী এখানে ধ্যান করতেন। খ্রিস্টানরা তাকে বলে ফাদার অব ডেজার্ড। ফাদার অব অল মঙ্কস। এই সেন্ট এন্থনিকে বলা হয় মোনাস্টিসিজমের জনক।
জাফরানা শহর থেকে দূরের নির্জন এলাকায় তাঁর মঠ। এখানে পাহাড়ের গুহায় বসে তিনি ধ্যান করতেন। প্রাচীনকালে এই মরুভূমির আরব দেশগুলোয় বলা হয় মানুষ বর্বর ছিল।
তখন রাষ্ট্র ছিলোনা। সমাজ শৃংখলা ছিলোনা। এসব উশৃংখল মানুষগুলোকে শৃংখলায় আনতে আবির্ভাব হয় ধর্মের। যেহেতু আরব দেশগুলোয় মানুষ বর্বর-উশৃংখল ছিল, কন্যা সন্তান জীবন্ত কবর দিতো!
তাই তাদের শৃংখলায় আনতে আরব দেশগুলোয় একের পর এক ধর্ম এসেছে। আর এসব ধর্মের গল্পগুলোও মোটামুটি এক রকম! এদের প্রধান ধর্মীয় চরিত্র পাহাড়ের গুহায় বসে ধ্যান করতেন।
সেন্ট এন্থনি তথা সাধু এন্থনিও ধ্যান করতেন পাহাড়ের গুহায় বসে। তিনি মারা যাবার পর তাঁর অনুসারীরা মঠটি গড়ে তোলেন। সেন্ট এন্থনি মারা যান ৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
এরপর সেই মঠটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে জন্যে এটি প্রায় ১৬ শ বছরেরও পুরনো মঠ। সে কারনে সারা দুনিয়ার খ্রিস্টান পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের জন্যে এ স্পটগুলোও বিপুল জনপ্রিয়। এরজন্যে সব ধর্মের পর্যটকরা সারা বছর মিশর যান।
সিনাইর দক্ষিন প্রান্তের রিসোর্ট শহর শার্ম আল শেখ। ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তির জন্যে বিখ্যাত এই রিসোর্ট। মার্কিন পরিকল্পনায় মিশর সেই নিষ্ফল শান্তি চুক্তির শরীক। এতে করে মিশর লাভবান হলেও ফিলিস্তিনিদের জীবনে শান্তি আসেনি।
জন্ম থেকে জ্বলছিই যেন ফিলিস্তিনের নিয়তি। মুসলিম উম্মাহ’র কথা বলে সব আরব দেশ! আর নিজেদের স্বার্থে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ ইসরাইল-আমেরিকার কাছে বিক্রি করে যারা চলে মিশর তেমন একটি দেশ।!
পর্যটন শহরটিকে মিশর তাদের মৎস সম্পদের প্রদর্শনী কেন্দ্র হিসাবে উপস্থাপন করে। তাদের দাবি হাজার প্রজাতির মাছ আছে মিশরীয় জলসীমায়। আছে ২৫০ টি কোরাল রিফ। ২৬০০ ফুট গভীর রিফ দেয়াল!
এখানে পৃথিবীর সেরা স্কাইভিং স্পট গড়ে তুলেছে মিশর। সাগরে পর্যটন খেলাধুলার নানান ব্যবস্থা সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে। আর আছে নানান প্রকারের সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা।
আপনি মাছ ফ্রাই খাবেন না ঝোল সহ রান্না করে খাবেন তা শুধু বলে দেবেন! সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে। এমন সব বাহারি মাছ পৃথিবীর খুব কম পর্যটন স্পটে পাওয়া-খাওয়া যায়!
এক্যুরিয়ামে আছে জ্যান্ত মাছ! দেখে পছন্দ করবেন। সেটি অথবা সে রকম মাছ সুস্বাদু রান্না হয়ে আপনার প্লেটে চলে আসবে। মাছের নানা রকম ডিশে সেখানকার রেষ্টুরেন্টের মেন্যুগুলো সাজানো। দামও আয়ত্তের মধ্যে।
হাজার হাজার বছর আগের ভয়াবহ ভূমিকম্পে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর ধংসের পাশাপাশি প্রাচীন অনেক কিছু পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সেই সব প্রত্মতত্ত্ব পানির নীচে রেখেই বিশেষ আন্ডার ওয়াটার ট্যুরিজম গড়ে তুলেছে মিশর।
এসব দেখতেও অনেকে আলেকজান্দ্রিয়া যান। প্রাচীন শহরটির এ আরেক বিশেষ প্রত্মতাত্ত্বিক আবিষ্কার। এই পানির নীচের পর্যটন নিয়ে প্রকাশিত নানা সুভেন্যুরে লেখা হয়েছে নানান কিছুর সচিত্র বিবরনাদি।
ক্লিওপ্যাট্রার যুগ থেকে নানাকিছু পাওয়া গেছে সেখানে পানির নীচে। যেগুলোর অনেক কিছু ভূমিকম্পে পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল। এসব উদ্ধার-প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আলেকজান্দ্রিয়ায় পানির নীচে মোটামুটি একটি শহরও পাওয়া গেছে। সেটি রানী ক্লিওপ্যাট্রার প্রাসাদ। ধারনা করা হয় দেড় হাজার বছর আগের ভূমিকম্পে এটি পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছি। সেখানে দেবী আইসিসিসের একটি মূর্তিও পাওয়া গেছে।
এমন নানান আবিষ্কারের জন্যে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মতো মিশরেও গড়ে উঠেছে বিশেষ একদল মেরিন প্রত্মতত্ত্ববিদ। আলেকজান্দ্রিয়ার পর্যটনেও তারা সেখানে আলাদা শাখা-অফিস-কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলেছেন।
ভূমধ্য সাগর-লোহিত সাগর-মৃত সাগরতলে পাওয়া যাচ্ছে আলেকজান্দারেরও আগের প্রাচীন মিশরের নানান স্মৃতি। প্রাচীন যুগের নানান রত্মভান্ডার যা ভূমিকম্পে পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল।
দেশটির আধুনিক কালের মেরিন প্রত্মতত্ত্ববিদরা এসব উদ্ধার-চিহ্নিত করা শুরুর পর প্রাচীণ বিখ্যাত নানান ইতিহাস-ঐতিহাসিকদের প্রশ্নের রহস্যগুলো উম্মোচিত হতে শুরু করে। তখন সংযোগ ঘটানো হয় নানান আবিষ্কার-উদ্ধারের।
যার যোগফল থেকে জানা যাচ্ছে প্রাচীন মিশরকে। প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়াকে। এর নানা সময়ের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ, গৃহযুদ্ধ, বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এমন নানাকিছু।
প্রাচীন মিশরে প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ায় শুধু মুসলিম নেতৃত্বে নয় খ্রিস্টান নেতৃত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। ভূমিকম্পে নানা স্মৃতি পানিতে তলিয়ে যায়। আজকের আধুনিক মিশরের আন্ডার ওয়াটার ট্যুরিজমও সে সবও উদ্ধার করেছ।
মিশরের সিনাই পেনিনসুলার পশ্চিমে লোহিত সাগরের অপর পাড়ে আফ্রিকা মহাদেশ। এর মিশর অংশে সুয়েজ সহ আরও কিছু শহর। বিখ্যাত সুয়েজ খালটি সেখানে। সুয়েজ খাল দিয়ে যাবার সময়ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়।
আলেকজান্দ্রিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে সুয়েজ খালের ওপারের শহরে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে আমাকে সারি সারি ভবন দেখিয়ে বলা হয় ইতিহাস। এক সময় ইসরাইলিরা এলাকাটি দখল করে নিয়েছিল।
তাদের দখলের পর সেই কলোনি ভবনগুলো গড়ে সেখানে ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছিল। মিশরের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইসরাইলিরা এলাকাটি ছেড়ে চলে যায়। এরপর এলাকাটি আবার মিশরের হয়ে যায়।
যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মিশরীয়দের ইসরাইলের বানানো সেই কলোনি ভবনগুলোতে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেখানে আগে ইহুদি উপাসনালয় ছিল। এখন মসজিদ হয়েছে। ইহুদির ঘর মুসলমানের হয়েছে। মানুষের হয়েছে কী?