প্রতিদিন সারা বিশ্বের নানা প্রান্তের লোকজন পিরামিড দেখতে যান। এটা শুধু আজকের দিনের কথা নয়। যখন মানুষ পৃথিবীটা দেখতে জানতে শিখলো তখন থেকে তারা পিরামিড দেখতে চান। দেখতে যান। কারন এটি যে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের অন্যতম।
আবার ১২ শতকে আল আজিজ উথমান নামের মিশরের উগ্র এক সুলতান পিরামিড ধংস করে দিতেও চেয়েছেন! কারন মুসলমান সুলতান তার সাম্রাজ্যে ফেরাউনের কোন স্মৃতি রাখতে চায়নি!
মোটা বুদ্ধির সেই সুলতান পিরামিড ধংসের চেষ্টা করে দেখেছে। ভাঙ্গতে পারেনি। পিরামিড ভাঙ্গা সহজ সম্ভব ছিলোনা। তবে সেই উগ্র শাসক পিরামিডের কিছু ক্ষতি করতে পেরেছে।
পেরেছে ইতিহাসের ঘৃণা কুড়াতে! কারন পিরামিড ধংসের চেষ্টা করেছে এমন বোকা মোটা বুদ্ধির দ্বিতীয় কোন সুলতানের নাম ইতিহাসে নেই। তার সেই ধংস চেষ্টার স্মৃতি আছে। পিরামিডের গায়ে আছে সে স্মৃতির দাগ।
কিন্তু পরবর্তী সময় থেকে আজকের যুগ পর্যন্ত বুদ্ধিমান মিশরীয় শাসকদের কেউ আর সে চেষ্টায় লেগে থাকেননি। উল্টো তারা গবেষনা-উৎকর্ষে পিরামিডকে দাঁড় করিয়েছেন মিশরের সম্পদ-ঐশ্বর্য্যে।
পিরামিড সমূহের নিরাপত্তা রক্ষায় এখন অবশ্য আলাদা আইন আছে মিশরে। তাই আপনি চাইলেই এখন কোন পিরামিডের গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারবেননা। এমন চেষ্টার সঙ্গে জড়িত কাউকে পাওয়া গেলে তাদের তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।
আবার এসব আইন হবার আগ পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২০০ বছরে মিশরের পিরামিড সমূহের চূড়ায় চড়ার চেষ্টা অথবা প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ১৬০০’র বেশি পর্যটকের মৃত্যুও হয়েছে।
পিরামিড সমূহ এখন মিশরের পর্যটন অর্থনীতির বড়সড় লাভজনক এক উৎসও। এবং পিরামিড ট্যুরিজম থেকে মিশরের বার্ষিক আয়ের পরিমান জেনেও পিলে চমকাবে। এখনকার মিশর সরকারের আয়ের অন্যতম উৎস এই পিরামিড ট্যুরিজম।
২০১০ সালের একটি হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। ওই হিসাব অনুসারে মিশরের পর্যটন বিভাগের ১২ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী পিরামিড ট্যুরিজমের সঙ্গে জড়িত। ওই বছর ১৪ দশমিক সাত মিলিয়ন পর্যটক পিরামিড দেখেছেন।
তাদের মাধ্যমে ওই বছরে মিশর সরকার আয় করেছে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এখন কায়রোর পাশের খুফু পিরামিড দেখার জন্যে ৪০ ডলারের একটি প্যাকেজ আছে।
কিন্তু আমি যখন পিরামিড দেখতে যাই তখন একদল স্থানীয় পর্যটকের সঙ্গে দেখায় টিকেট কিনতে হয়েছে তিন দফায়। কারন মিশর সরকার পিরামিড অর্থনীতিকে তিনভাগে ভাগ করে নিয়েছে।
পিরামিড এলাকায় ঢুকতে ঘুরতে এক টিকেট, পিরামিডের ভিতরে ঢুকতে আরেক টিকেট। পিরামিডের ভেতরের মমিগুলো তারা স্থানান্তর করেছে সংশ্লিষ্ট জাদুঘরে। জাদুঘরে ঢুকতে একটা টিকেট করতে হয়। ফেরাউনের মমি যে কক্ষে রাখা আছে সে কক্ষে ঢুকতে কিনতে হয় পৃথক টিকেট।
পিরামিডের ভিতরে ঢুকে এর চূড়া পর্যন্ত হেঁটে উঠতে এখন নিরাপদ-টেকসই কাঠের সিঁড়ি পথ আছে। কিন্তু পিরামিড যখন নির্মান করা হয় তখন এর চূড়ায় পৌছবার পথকে ফারাও রাজার স্বর্গে যাবার সিঁড়ি পথ হিসাবে ভেবে তৈরি করা হয়েছে।
পিরামিডের নির্মান নকশায় এমন ব্যবস্থা রাখা হয় যাতে সূর্য রশ্মির আলো পৌঁছতে পারে সম্রাটের শেষ শয্যা পর্যন্ত। তখন ধারনাটি এমন ছিল যে ওই সূর্য রশ্মির মাধ্যমে স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হবে ফারাও রাজার।
পিরামিডের ভিতরের চূড়ার মতো অংশটাই ফারাও রাজার শেষ শয্যার স্থান। সেখানেই রাখা হয় রাজার মৃতদেহের মমি। নীলনদের বন্যায় যাতে রাজার মমি ভিজে নষ্ট না হয় সে জন্যে চূঁড়ার অংশটা এমন নিরাপদ তৈরি করা হয়।
সেখানে দাঁড়ালে আপনার বেশ শীতল একটা অনুভব হবে। অনেক পথ পেরিয়ে সেই জায়গাতে পৌঁছবার পর আপনার মতে মনে হতে পারে সেটি একটি পরিত্যক্ত কক্ষ। কায়রোর গিজার সেই খুফু গির্জার চূঁড়োর অংশটায় লাল রঙের আঁকা কিছুর ছবির মতো কিছু অনুভবও আছে।
ফ্রেন্স সেনাপতি এবং সম্রাট নেপোলিয়ন পিরামিড দেখে বলেছিলেন, গ্রেট পিরামিড। তখন নেপোলিয়ন পিরামিডের ভিতরে একটা রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। শুধু ভিতরে নয়। ফারাও রাজার মৃতদেহের মমি যেখানে শুইয়ে রাখা ছিল সেই চেম্বারে একা রাত কাটাতে চাইলেন নেপোলিয়ন।
নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত সচিব পরে বলেছেন তিনি তাকে এভাবে পিরামিডের ভিতরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা শোনেননি। কোন রকম আলোর ব্যবস্থা ছাড়াই অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়েই মৃত রাজার শেষ শয্যার কাছে চলে গিয়েছিলেন নেপোলিয়ন।
এখন আলোকিত সে পথ ধরে পিরামিডের চূঁড়োর পাটাতন অথবা রাজার শেষ শয্যা পর্যন্ত যেতে একজন পর্যটকের মোটামুটি ১৫ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু সেই অন্ধকার রাতে সে পথ যেতে নেপোলিয়নের কতো সময় লেগেছিল তা তিনি বলেননি।
পরের দিন সকালে দিনের আলো উজ্জ্বল আলোয় রাজার শেষ শয্যার কাছ থেকে নেমে আসেন নেপোলিয়ন। কিন্তু তাঁর সারারাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কোন কথা বলেননি। সে জন্যে পিরামিড সম্পর্কে একটি উক্তিই এখন পর্যন্ত টিকে আছে। তাহলো গ্রেট পিরামিড।
পিরামিডের ভিতরে যাওয়া আসা নিয়ে নানা রকম ভৌতিক গল্পও চালু আছে। সময় বাঁচাতে অনেক সময় গাইড ভিতরে তেমন কিছু নেই বলে যেতে অনেক পর্যটককে নিরুসাহ দেখান।
কিন্তু আমি বলবো, আপনি যদি কখনো পিরামিড দেখতে চান তাহলে অবশ্যই ভিতরে যাবেন। সেটি আসলেই একটি বিশেষ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। পিরামিডের নির্মান শৈলী জানতে বুঝতেও আপনার এর ভিতরের জগতটা দেখা জানার দরকার আছে।