আমাদের কথা যে কারনে মানুষ এখন শোনেনা

বাংলাদেশের কিছু সাংবাদিকের লেখা আমি মন দিয়ে পড়ি। কারন তাদের সংগ্রাম আমার চোখে দেখা। আমরা দেখেছি পরষ্পরের সংগ্রাম। কয়েক সাংবাদিক প্রায় বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শুদ্ধ দেখতে চেয়ে লিখেন।

তা পড়তে ভালো লাগে। একজন প্রায় নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে লিখেন! বাজারে তখন ছাত্রলীগের নামে ব্র্যাকেটবন্দী অনেকগুলো ছাত্রলীগ ছিল। বাসদ মাহবুবেরও একটা ছাত্রলীগ ছিল। মান্না তখন সেই বাসদের নেতা।

কিন্তু আসল ছাত্রলীগার সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বা মঞ্জুরুল ইসলামরা তখন প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু ছিলেন। অনেকে তাদের দেখা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের শুদ্ধ জীবনের গল্প উল্লেখ করেন। যা সত্য।

যদিও তা এখন এই প্রজন্মের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছেলেমেয়েদের কাছে শুধু গল্পের মতো শোনায়। কারন সময় প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। আর তারা যেভাবে দেখতেন এবং এখনও ভাবছেন সেই সময়ও আর ফিরবেনা।

যেমন ফিরবেনা তার সংগ্রামের দিনগুলোও। একজনের সংগ্রাম দেখেছি। মিরপুর থেকে প্রতিদিন বাদুরঝোলা বাসে চড়ে মতিঝিলের দিকে তার আসা-যাওয়ার সংগ্রাম। আমাকে আপন জেনে-বুঝে মাঝে মাঝে নিজের হতাশার কথা শেয়ার করতেনও।

বলতেন, ভাই আমার পড়াশুনা কম। এখানে ভালো চাকরি পাবোনা। এরচেয়ে ভালো মিডলইস্টে চলে যাই। আমি তাকে বলতাম, ভাই লেগে থাকো। এখানে এতো পড়াশুনা লাগেনা। লেগে থাকলে একদিন ভালো কাজ পাবে।

তখন মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হয়ে না গিয়ে সেই লেগে থাকার সাফল্য তিনি পেয়েছেন। প্রতারক সাহেদের ঘটনায় অনেকের দিকেও এখন সন্দেহের আঙ্গুল! অথচ সংগ্রামী সৎ সাংবাদিকের সংখ্যা এখনও দেশে এখনও কম নয়।

সাংবাদিক মানেই সাহেদ নয়। সাহেদের মতো বিশেষ কিছু সাংবাদিকের অসৎ বিত্ত-বৈভব্য-দাপটের গল্প যখন তার সহকর্মীদের মুখে যখন শুনি তখন অবাকই লাগে। ভাবি বাংলাদেশের মিডিয়া কেনো এখন পথ হারিয়েছে।

তখন মনে হয় দূর্বৃত্তায়ন শুধু দেশের রাজনীতিতে নয়, মিডিয়া সহ সবক্ষেত্রেই ঘটেছে। অথবা হাতে হাত ধরে ঘটেছে রাজনীতি আর মিডিয়া সহ সবকিছুর দূর্বৃত্তায়ন। একটা দেশের রাজনীতি শুদ্ধ না থাকলে কোন কিছুই শুদ্ধ থাকেনা।

নতুবা আলাদীনের চেরাগ পাওয়া ছাড়া এসব কী করে সম্ভব হয়েছে? নতুবা কিছু সাধারন মানের সাংবাদিকের এত গায়েবি বিত্ত-বৈভব হয় কী করে। বাংলাদেশের জীবনে এভাবে হেসেখেলে কারো বিত্ত-বৈভব্যে টুই-টুম্বুর গড়ে উঠতে পারেনা।

আর যদি সৎভাবে ঘটে থাকে তাও বলতে হবে মিরাকল। এ নিয়ে থিসিস গবেষনা হতে পারে। কারন মিরাকলরা সাংবাদিক হিসাবেও এমন বিশেষ কেউ কখনও ছিলেননা। এমন একটা রিপোর্ট তারা দেখাতে পারবেননা।

আমাদের সময়ে মেধাবী সাংবাদিকতার অন্যতম মানদন্ড ছিলো ফিলিপস পুরস্কার। ফিলিপস পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিকদের সমীহ করা হতো। সেই পুরস্কারের সঙ্গে আবার নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকাও পাওয়া যেত।

একজন সৎ সাংবাদিকের জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা মানে তখন অনেক টাকা। যারা ভালো সাংবাদিকতা করতেন তাদের মনের মধ্যে ফিলিপস পুরস্কারের স্বপ্ন কাজ করতো। স্বপ্ন দেখেও আমি কখনও ফিলিপস পুরস্কার পাইনি।

নূরজাহান স্মৃতি পুরস্কার যেটি পেয়েছিলাম, এরসঙ্গে টাকা ছিল পঁচিশ হাজার। সেটাও তখন আমার জন্যে অনেক টাকা ছিল। জীবনে সেটিই ছিল একসঙ্গে বেশি রোজগার। সিলেটে ফতোয়ার শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করা নূরজাহানের স্মরনে পুরস্কার।

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি সেই পুরস্কার প্রবর্তন করে। জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে কবি সুফিয়া কামাল সেই পুরস্কার হাতে তুলে দেন। অনুষ্ঠানে আমার ছোট বোন সঙ্গে গিয়েছিলেন।

উড়নচন্ডি বড়ভাইকে তিনি চিনতেন জানতেন। তাই ভাই খরচ করে ফেলবে, ভাইর কোন সঞ্চয় নেই এটি ভেবে সেই পুরস্কারের পঁচিশ হাজার টাকার চেক তার হাতে নিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। যেটা এখন আমার পাঁচশ ডলারের কম।

এখন সাংবাদিকতার পুরস্কারের সঙ্গে আরও মোটা অংকের টাকা দেয়া হয়। কিন্তু এসব নিয়ে অত হৈচৈ নেই। কারন নানা কারনে দেশের সাংবাদিকতার সম্মান আর আগের মতো নেই।

আজকে দেশের তেমন সাধারন মানের কিছু সাংবাদিক এখন টাকার কুমির! এদের কেউ কেউ এক সময় একটি স্থায়ী চাকরি বিহীন অবস্থায় বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় খেপ লিখে বেড়াতেন। তবে তখনও তাদেরকে বৈষয়িক মনে হতো।

এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখন নিউজ এজেন্সির সাইনবোর্ড আসে! নিউজ এজেন্সি বলতে বাসস আর ইউএনবি। চট্টগ্রাম থেকে একটি সংবাদ সংস্থা করার চেষ্টা করছিলেন নিজাম উদ্দিন নামের একজন সিনিয়র সাংবাদিক।

সেটি আর ঢাকার বেসরকারি উদ্যোগের সংবাদ সংস্থা আলোচনায় ছিল।পরে বগুড়ার করোতোয়া, খুলনার পূর্বাঞ্চলের ঢাকা অফিস ভিত্তিক সংবাদ সংস্থাও হয়। কিন্তু এগুলোর লেখা কোন পত্রিকা ছাপলেও শুনতাম তারা টাকা পয়সা তেমন দেয়না।

পয়সা নয় এরা চাইতেন পত্রিকায় পাতায় ছাপার অক্ষরে তাদের এজেন্সির নাম! ১৯৯৬ শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফেরান ২১ বছর পর। একটি ট্রেন দূর্ঘটনার ঘটনাস্থলে হেলিকপ্টারে উড়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাকে অনুসরন করে দ্বিতীয় হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে আমাদের সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক বেকার সাংবাদিকও গেছেন সেই সাংবাদিক হেলিকপ্টারে। তাকে তখন মজা করে বলি আপনি যে এলেন, কোথায় লিখবেন।

তিনি জবাব দিয়ে বলেন, আমি কি এখানে সাংবাদিকতা করতে এসেছি নাকি। আমি একদিন এ এলাকা থেকে নির্বাচন করবো। এখন এলাকার লোকজন আমাকে দেখলো আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হেলিকপ্টারে এসে নেমেছি।

মানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আমার যোগাযোগ রয়েছে। তার গোছানো উত্তরে তখন চমকে গিয়েছিলাম। সাহেদের সেলফি সমগ্র দেখতে দেখতে সে ঘটনা মনে পড়েছে! তখন সাংবাদিক সংখ্যায় কম ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন আমাদের প্রায় সবাইকে নামে চেহারায় চিনতেন। সেই সাংবাদিককেও চিনতেন। তবে তিনি তখন বিষয়টি নিয়ে যেভাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতেন আমাদের মাঝের আর কেউ সেভাবে চিন্তা করতেন কিনা জানিনা।

তিনি বিষয়টা যে মজা করে বলেছিলেন তাও তখন মনে হয়নি। কিন্তু যেভাবেই তখন বলেননা কেনো তা তার আজকের আলাদিনের চেরাগের সঙ্গে মিলে গেছে। তিনি এখনও এমপি হননি ঠিক, লেখায় নিত্য অনেক এমপির ওপর ছড়ি ঘোরাতে চান!

মানুষ মুগ্ধ হয়। সব কাহিনী জানেনা সরল মানুষেরা। মেধায়-যোগ্যতায় তাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে থাকা অনেক লোকজনকে আজ তার অধীনে কাজ করতে হয়! আর মন্দ ভাগ্যে দেশের হাজার হাজার মেধাবী সাংবাদিক আজ দুঃস্থ!

আসল অথচ দুঃস্থ সাংবাদিকের ভিড়ে কয়েকজন হয়ে গেছেন সোনার খনির মালিক! সৎ মেধাবীদের দুঃস্থ সাংবাদিকদের এক রকম উপহাস করে এরা লিখেন তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের বিদেশে পড়েছেন! ছুটি কাটাতে অমুক অমুক দেশে গেছেন!

অথচ বিদেশে বাংলাদেশের যে সব ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে বা করেছে তারা জানে তাদের হার্ড লাইফ। এমন সোনার চামচ মুখের সংখ্যা হাতে গোনা। এই কথিত সোনার চামচওয়ালাদের বাপ-মা বাংলাদেশের একেকটা বড় বড় চোর-বাটপার।

অথচ তাদের চেয়ে যোগ্য মেধাবীরা যেখানে নিয়মিত বেতন পাননা, বাড়িভাড়া দিতে পারেননা, চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন, সেখানে কম মেধাবী অসৎদের জন্যে ঢাকা শহরে অট্টালিকা বানিয়ে দিয়েছে কোন পয়গম্বর?

আমি এমন একজনকে যখন চিনতাম দেখতাম তখন বড় ভাই ভাড়া বাসায় থাকতেন। অগোছালো ময়লা কাপড়ের সেই সংগ্রামী যুবককে তখন শেখ হাসিনাও দেখতেন-চিনতেন। তার হঠাৎ বৈভব শেখ হাসিনার নজরেও পড়ার কথা।

কাজেই এমন লোকজনের বিত্ত-বৈভবের হঠাৎ তদন্তের নিউজ যখন হয় তা শেখ হাসিনার জানাশোনায় হবার কথা। আবার সেই আদেশ কিভাবে থামানো হয়েছে সে খবরও শেখ হাসিনার কান পর্যন্ত যায়নি এমনও নয়।

আমাদের এমন সবার আমলনামার সাক্ষী দেশের অনেক মানুষ। আমাদের সবার বড় হওয়া দেশের অনেকের চোখের সামনে ঘটেছে। বিগ ফ্রড সাহেদ প্রশ্রয়ের মানুষের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে হবে। উত্তর বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে হবে মানুষের কাছে।