মা দিবসে আমার বন্ধুদের অনেকে যার যার মা নিয়ে ছবি সহ লিখছেন। আমার বৃদ্ধা আম্মা থাকেন কুলাউড়ার গ্রামের বাড়িতে। ছোট ভাইদের স্ত্রী, তাদের সন্তানরা তাকে সারাক্ষন মায়ায় আঁকড়ে রাখেন।
ফোন করে কী দিয়ে খেয়েছেন জিজ্ঞেস করলেই নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, বয়সের কারনে তিনি কিছুই এখন মনে রাখতে পারেন না। তাকে তখন একটাই কথা বলি। তাহলো, আপনার কিছু মনে রাখার দরকার নেই। আমাদের জন্যে শুধু আপনি বেঁচে থাকুন আম্মা।
আমি না হয় এই মা দিবসেও আমাদের সবার মা, মাতৃভূমি জন্মভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে লিখি। এই করোনার সময়ে ভালো নেই আমাদের বাংলাদেশ মা। সন্তানদের নানা দূর্যোগ চিন্তায় তার মন ভালো নেই।
উন্নত বিশ্বে যারা মা দিবসটাকেও একটি বিজনেস ইভেন্ট হিসাবে গড়ে নিয়েছে, বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতেন প্রতিবছর মাদার্স ডে’তে। করোনা দূর্যোগের কারনে, তাদের ব্যবসা চিন্তার পুরোটাই ভন্ডুল হয়েছে।
আর সেই সব দেশের যাদের অনেকে বছরে ঘটা করে একদিন মাদার্স ডে’তে তাদের মায়েদের খোঁজ নেন তাদেরও এবার দিনটি ভালো যায়নি! কারন এই মাদার্স ডে’তে মায়ের সঙ্গে দেখা করা নিয়েও অনেক দেশ শর্ত জুড়ে দিয়েছিল!
যেহেতু এই কভিড নাইন্টিনের বড় টার্গেট বয়স্ক লোকজন তাই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, বয়স্ক নিবাসে যাবার বিষয়ে নানা ভাবে সতর্ক করা হয়েছিল যাতে তাদের কারনে মায়েরা সংক্রমনের ঝুঁকিতে না পড়েন।
চলুন এবারে মা দিবসে বাংলাদেশের ভালোগুলো খুলে খুঁজে খুঁজে লিখি আর পড়ি। ঢাকার মতিঝিল থানায় আগে দিনে প্রায় ২০০ অভিযোগে নানা মামলা দায়ের হতো। সেই অভিযোগ মামলার সংখ্যা এখন হাতে গোনা।
আসামী শূন্য থানার হাজতখানা! সারাদেশেরই এখন একই পরিস্থিতি। যেহেতু অপরাধের ঘটনা-মামলার সংখ্যা কমে গেছে, তাই পুলিশের সদস্যরাও করোনার দূর্যোগ সামাল দেবার নানান কাজে সময় দিতে পারছেন বেশি।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন অপরাধীরা তাহলে গেলো কোথায়? খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তাদের প্রায় সবাই এখন ত্রানের কাজে ব্যস্ত। ১৯৮৮ বা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় দেশে প্রায় একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
অথবা নব্বুইয়ের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়গুলোয়ও যখন এক রকম রাষ্ট্র ছিলোনা, সরকার ছিলোনা, তখনও বাংলাদেশের এলাকায় এলাকায় অপরাধও প্রায় এক রকম শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছিল!
আবার রাষ্ট্র যখন আবার পুনর্বহাল হয়, নিজের আসনে আবার ঠিকঠাক বসে পড়ে, তখন এর অপরাধপ্রবন চেহারা-চরিত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে যেন অপরাধীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে আমার ধারনা এই করোনা মহামারীর অভিজ্ঞতায় আগামীতে বাংলাদেশের অপরাধের চেহারাও কমে আসবে এবং ধারনা পাল্টাবে। এবার সবাই যার যার স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিগুলো চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখেছেন।
মানুষের অন্তত ধারনা বেড়েছে যে আমরা যে যেখানে যাই করিনা কেনো, মহামারীর মৃত্যুর কাছে আমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলোও অসহায়। প্রকৃতির প্রতিশোধের সামনে এখন আর কেউ কোথাও নিরাপদ নয়।
এখন এই বাংলাদেশেরও করোনা মহামারীর হট স্পট তথা সদর দফতরও যখন ঢাকা শহর তখন, এই রাজধানী অভিমুখে মানুষের জনস্রোত নিয়ে যারা রিপোর্ট করছেন তারাও এসব মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কথা ভাবছেননা!
আমিতো মনে করি সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের মনই যেখানে ভালো নেই তাদের কাছে স্বাভাবিক আচরন আশা করে কী লাভ! আর এই মানুষেরাতো চুরি করতে লুটতরাজ করতে ঢাকা ছুটে আসছেন না। জীবন জীবিকা রক্ষায় আসছেন।
কাজেই আমরা যারা নতুন নতুন সময় পরিস্থিতির সময়ানুগ পর্যালোচনা না করে নিজস্ব মুখস্ত বিদ্যার বুদ্ধির ভিত্তিতে চলি, মহামারীতে আক্রান্ত সময়ের মানুষের আচার আচরন সম্পর্কে আমাদের সবার আরও পড়াশুনা করা উচিত।
কারন এখন যে বাংলাদেশ সবাই দেখছি আগামী তিন মাসের মধ্যে আরও সংকটের বাংলাদেশকে দেখতে হবে!
কারন এই তিন মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ফিরে আসবেন উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি শ্রমিক। যারা এতদিন বিদেশে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকার রেমিটেন্স পাঠাতেন আর অনেকে কম্পিউটারের কী বোর্ডে নানান গবেষনার তুবড়ি ফোটাতেন!
সেই রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অনেকে এই মহামারীর দূর্যোগের কারনে কাজ হারিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসছেন। তাদের অনেকেও এখন দেশে এসে করোনায় মারা যাবেন। আবার হয়তো বিদেশ যাবেন তাদের অনেকে।
অথবা তাদের কেউ কেউ আর কোন দিন বিদেশ যেতেই পারবেননা। অতএব, প্রিয় পন্ডিত অথবা পন্ডিতনমন্য। বাংলাদেশে বসে কিন্তু আমাদের সবারই নিজেদের একেকজনকে এমন পন্ডিত অথবা পন্ডিতনমন্য মনে হয়!
কিন্তু বিদেশ যাবার পরই আমরা আমাদের ওজন করতে শিখি! এই যে বিদেশ থেকে এত লোক এখন ফিরে আসছেন, বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্স যে তলানিতে তা আরও চলবে বেশ কিছুদিন।
করোনার কারনে সেই সব দেশের অবস্থাও নাজুক। সেই সব দেশেও কাজ হারিয়েছেন বাংলাদেশি সহ লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা যখন আবার কাজ ফিরে পাবেন, খুব তাড়াতাড়ি রেমিটেন্সের হারও দেখবেন বাড়তে শুরু করবে।
কারন বিদেশে আমরা কাজ পেলেই করি। কাজ পেলে শক্রবার রবিবার বা কোন ছুটির দিন বাছবিচার করিনা। কারন আমাদের মাথায় যে সারাক্ষন থাকে বাংলাদেশ। দেহটা বিদেশে থাকলেও মনটা সব সময় থাকে দেশে।
মায়ের জন্যে টাকা পাঠাতে হবে। এই চিন্তাটা প্রবাসী সবার মধ্যে সবার আগে কাজ করে। এরজন্যে বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ প্রবাসী আয়, এসবও কিন্তু প্রথম সুযোগে আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমনের ৬৪ তম দিনে সর্বোচ্চ ৮৮৭ জন সংক্রমনের তথ্য পাওয়া গেছে। ছোট বাংলাদেশে যে বিশাল জনসংখ্যা, যেভাবে সবখানে গাদাগাদি মানুষের চলাচল, বিশ্বাস করুন এই সংখ্যাটা আহামরি কিছু নয়।
এই সময়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশে স্পেনে ১১ হাজার ৬৪৭ জন মারা গিয়েছিলেন। আশার কথা দেশের অন্যান্য স্থানগুলোতেও সংক্রমন কিন্তু ঢাকার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছেনা।
সিলেট সহ বাংলাদেশের অনেক এলাকার সংক্রমন কমে আসছে। মানুষ যে এভাবে বেরিয়ে পড়েছে তা নিয়ে এই হা-হুতাশ না করে আমাদের কথা যারা শুনে সেই মানুষগুলোকে আমরা যার যার প্রভাবে ঘরে রাখতে পারলে সংক্রমন কমে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে রবিবার যে সব প্রতিষ্ঠান ত্রানের চেক দিয়েছে এর পরিমান দেখেছেন? বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি বলে পরিচিতদের দেয়া ত্রানের পরিমান দেখেছেন? এটাই কিন্তু বাংলাদেশের সামর্থ্য।
কাজেই এসব যাতে আমরা ভুলে না যাই। পাশের দেশ ভারতের ধনাঢ্য ব্যক্তি, মুম্বাইর শিল্পীদের দানের পরিমান অনেক অনেক বেশি। আমাদের অনেক কষ্টে ক্রিকেটার খেলোয়াড়দের ব্যাট-বল-জার্সি এসব নিলামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে টেস্ট কম বলে আক্রান্ত কম জানা যাচ্ছে বলে এমন একটি প্রচারনা আছে। হয়তো এই ধারনাটিও সত্য। টেস্ট ভুল হচ্ছে এটাও সত্য। এটিই আমাদের সামর্থ্য। হঠাৎ করে চন্দ্র থেকে টেস্টের লোকজন নিয়ে আসিনি।
কিন্তু এর বাইরেও আমার একটি ধারনা আছে। তাহলো টেস্ট ছাড়া লোকজনের বিপুল সংক্রমন হয়ে থাকলে তাদের অনেকে এতোদিন বেঁচে থাকতেননা। কাউকে খুশি বা অখুশি করার চিন্তা থেকে মহামারী সংক্রমন বা মৃতের তালিকা করেনা মহামারীর নিজস্ব ডায়েরি।
এবং দিন শেষে বাংলাদেশের করোনা যুদ্ধজয়ের বড় শক্তির নাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর মতো একজন সাহসী ফুলটাইমার প্রধানমন্ত্রী আর কোন দেশের নেই। তাঁর মতো একজন ফুলাইমার রাজনীতিক-সবকিছুর নির্দেশক দ্বিতীয়জন আওয়ামী লীগ বা বাংলাদেশের আর কোন দলে নেই।
এরজন্যেও বাংলাদেশ এই যুদ্ধে হারবেনা। আমেরিকার আজকের দূর্যোগের কারন যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো পাগলাটে প্রেসিডেন্ট তা এখন সে দেশের লোকজন জানেন বলেই তাদের এখন মনভাঙ্গা।
শেখ হাসিনার শ্রমনিষ্ঠা-একাগ্রতা নিয়ে তাঁর শত্রুদেরও দ্বিমত নেই। এ নিয়েই দুশ্চিন্তায় তাঁর শত্রুরা নিত্য ভুলভাল বলে লেখে। তাদের ভুলভালে বাংলাদেশ চলেনা বলেই আমাদের দেশ এই যুদ্ধেও জিতবে।