ভারত পাকিস্তানের বাইরে আমার প্রথম বিদেশ দেখা মানে সিঙ্গাপুর। ১৯৯৭ সাল। প্রথম বার সিঙ্গাপুর যাই ট্রানজিট যাত্রী হিসাবে। আমি তখন মিশর যাচ্ছিলাম। সিঙ্গাপুর এয়ালাইন্সের যাত্রী হিসাবে সকালে সিঙ্গাপুর নেমে সারাদিন ঘুরে বিকালে আবার কায়রো রওয়ানা হয়ে যাই।
সিলেটের মাগুরছড়ার গ্যাস ফিল্ডের দূর্ঘটনার আগুন নেভার পর আমাকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশে মিশর পাঠায় জনকন্ঠ। ওই গ্যাস ফিল্ডের আগুন নেভাতে সিঙ্গাপুর থেকে ফায়ার ফাইটার আনা হয়েছিল।
তারা প্রতিদিন সেজেগুজে আগুনের পাশ দিয়ে হাঁটতো আর আর ছবি তুলে লিখলাম। তাদের কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতোনা। আমরা লিখতাম খামোখা এদের সিঙ্গাপুর থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। আগুন নিভানোর কিছুই তারা করছেনা।
সেই ফায়ার ফাইটারদের একজনকে পেয়ে গেলাম চাঙ্গি এয়ারপোর্ট। মিশর যাচ্ছি শুনে সে জানতে চাইলো ওখানেও কোন গ্যাস ফিল্ডে আগুন লেগেছে নাকি। তার কথায় আমি হেসে ফেলি।
সে হয়তো ভেবেছে আমি তার মতো কেউ একজন আর কী! গ্যাস ফিল্ডের আগুন নিয়ে লেখার রিপোর্টার! সে যেমন এমন আগুনের স্পটে ভাড়ায় যায়, আমিও বুঝি গ্যাস ফিল্ডের আগুনের খবর শুনলেই সেই স্পটে ছুটে যাই!
দেশে কথা না বললেও সিঙ্গাপুরে সে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো। বললো ওই অবস্থায় তারা উপর থেকে কোন কৌশলের মাধ্যমে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হয়ে তাতে ভূগর্ভে বিস্ফোরন ঘটতে পারতো।
তাই তাদের অপেক্ষা ছিল গ্যাসের ওই স্তরটি পুড়ে শেষ হয়ে গেলে আগুন এমনি এমনি নিভে যাবে। আগুন যাতে লোকালয়ে না ছড়ায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটিই তাদের প্রশিক্ষন।
ট্রানজিট যাত্রী হিসাবে সেই প্রথমবার সিঙ্গাপুর দেখার পর অবশ্য বিভিন্ন সময়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স অথবা সিঙ্গাপুর টুরিজম বোর্ডের গেষ্ট হিসাবে ছোট দ্বীপ দেশটায় যাওয়া হয়েছে। তাদের দেশ দেখিয়ে রিপোর্ট লিখিয়ে টুরিস্ট টানার জন্যে তারা পাঁচতারকা, সাত তারকা হোটেলে রাখতো।
ভালো ভালো জায়গায় খাওয়াতো। সঙ্গে থাকতো সর্বক্ষনিক গাড়ি-গাইড। বিজনেস বুদ্ধিতে মুসলিম গেষ্ট দেখে একজন মুসলিম গাইডও দিতো।
আবার তাদের প্রোগ্রামের বাইরে যখন নিজের মতো এক-দু’দিন থাকতাম তখন থাকতাম তিরিশ-পঞ্চাশ ডলারের রূমে। সিঙ্গাপুরের বিদেশি শ্রমিকদের কমন গন্তব্য মোস্তফা সেন্টারের পাশে কোন একটি বাংলাদেশি হোটেলে হাত মাখিয়ে ভাত খেতাম।
আমরা যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র আমাদের বিনোদন মানে সিনেমা, বিটিভির নাটক-পূর্ন দৈর্ঘ বাংলা ছায়াছবি দেখা, পত্রিকা পড়া, দস্যু বনহুর, কুয়াশা-মাসুদ রানা সিরিজ, নিমাই, নীহার রঞ্জন ভট্টাচার্য, শরৎ চন্দ্র এমন যেটা যখন পাই গোগ্রাসে পড়া।
আমি আবার সিনেমার পোকা থাকায় খুব ছোটবেলা থেকে চিত্রালী-পূর্বানী এসব সিনেমা পত্রিকা পড়তাম, সেগুলোর পাঠকের পাতায় চিঠি লিখতাম। আমাদের শহর কুলাউড়ায় তখন লিলি-পুবালী নামের দুটি সিনেমা হল ছিলো।
টিনের চালা, বাঁশের বেড়ার লম্বা হলঘর। সামনের দিকের সস্তা আসনগুলোতে থাকতো ছারপোকায় ভর্তি বেঞ্চ। লিলি-পূবালিতে নতুন একটি ছবি এসেছে আর আমি দেখিনি এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবেনা। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল সময়ের আমি ছিলাম একনিষ্ঠ দর্শকদের অন্যতম।
আমাদের শহরে পত্রিকা কেনা-পড়ার মুখস্ত গন্তব্য ছিল কুলাউড়া রেলওয়ে বুক স্টল। সেখানে গিয়ে চারপাশে ভালো করে দেখে বড়দের কেউ যাতে সিনেমা পত্রিকা চিত্রালী-পূর্বানী পত্রিকা কেনা না দেখে ফেলেন সে কারনে চরম সতর্কতায় টুপ করে সেটি কিনে শার্টের ভিতরে লুকিয়ে বাসায় আসতে হতো।
বাসায় ফিরেও সেটি এমন গোপনে বের করে পড়তে হতো যাতে বড়রা দেখে না ফেলেন। এমন পত্রিকায় চিঠি লিখতে লিখতে বিষয়টা এমন নেশায় পেয়ে যায় যে সপ্তাহে চার পাঁচটি পত্রিকায় লেখা ছাপা না হলে মন খারাপ থাকতো। পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার আনন্দ-গৌরবের অনুভূতি।
এমনও হতো, ছাপা চিঠিটা কেটে পকেটে এমনভাবে যত্মে রেখে বন্ধুদের কাউকে পড়াতে পারলে যেন নিজের গৌরব বেড়ে যেতো। এসব অনেক ছাপা চিঠি খাতার পাতায় পেস্ট করে সেগুলোর বড়সড় সংগ্রহশালাও গড়ে উঠতো।
পত্রিকায় এমন লিখিয়েদের তখন আলাদা আলাদা গ্রুপও গড়ে উঠতো। যেমন ববিতা, শাবানা, সুজাতা, সুচরিতা ভক্ত গ্রুপ সহ এমন নানাকিছু। এমন অনেক পত্রিকায় চিঠি লিখিয়েরা পরে লেখার জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে লিখতেন তসলিমা নাসরিন।
বিচিত্রা সহ কিছু পত্রিকায় পয়সার বিনিময়ে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে ব্যক্তিগত মতামত ছাপার জায়গাও ছিল। এসব মতামতকে কেন্দ্র করে পক্ষে বিপক্ষে নানান বিতর্কও জমে উঠতো। যেমন ফেনীর একজন একবার বিজ্ঞাপন দিলেন ‘বাংলাদেশের সব মেয়েরাই চরিত্রহীনা’!
তসলিমা নাসরিন এর জবাবে লিখলেন, ‘—সাহেব এতোদিন পর নিজের একটা ভালো পরিচয় দিলেন! নিশ্চয় কোন চরিত্রহীনা মায়ের গর্ভ থেকে—!’ তখন থেকেই এভাবে লিখতেন তসলিমা নাসরিন।
চিত্রালীর পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ, চিপাচস নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে তখন একটি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা অনেক চরিত্র এখনও দেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের শীর্ষ চরিত্র।
চিপাচসের সদস্যরা বছরে পত্রিকার একটি সংখ্যা বের করতেন। সেই সংখ্যার কাজে ঢাকায় গিয়ে কাজ করা আমার ঢাকার প্রথম সাংবাদিকতা। চিত্রালী সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তখন মগবাজার মোড়ের এক চায়নিজে চিপাচসের সদস্যদের চায়নিজ খাওয়াতেন। সেটি প্রথম ঢাকায় চায়নিজ খাওয়া।
চিপাচসের সঙ্গে প্রথম আমরা একটা সেমিনারে এফডিসিতে যাই। সেই প্রথম এফডিসি দেখা। নকল ছবির বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল চিপাচসের। দেলোয়ার জাহান ঝন্টু নামের তখন এক পরিচালক ছিলেন যিনি এসব ছবি বানাতেন। ঝন্টুর লোকজন তখন হকি স্টিক নিয়ে আমাদের মারতে তেড়ে এসেছিল। তাদের শ্লোগান ছিল ‘চিপাচস কী পাইচস’! সেই চিপাচস সংগঠন, সেই বন্ধুদের সখ্য এখনও টিকে আছে।
‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’ নামের একটি ছবি তখন খুব জনপ্রিয় হয়। কারন ছবির কিছু দৃশ্যের শুটিং সিঙ্গাপুরে হয়। চলচ্চিত্রে রঙ্গিন দৃশ্যধারন তখন সবে শুরু হয়েছে। ছবির পোষ্টারে লেখা থাকতো ‘আংশিক রঙ্গিন’, ‘সম্পূর্ন রঙ্গিন’।
তখন ট্রানজিটের যাত্রীদের শহর ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ভিসা দেয়া হতো। আমিও ভিসা নিয়ে শহর দেখতে বেরিয়েছি। প্রথম সিঙ্গাপুর দেখা মানে আমার কাছে তখন ববিতা-মাহমুদ কলি অভিনীত দেখা ছবি ‘লাভ ইন সিঙ্গাপুর’।
মোস্তফা সেন্টারের পাশের একটি বারের বারান্দার একটা পাথরের সাদা টেবিলে এক গ্লাস বিয়ার নিয়ে বসে লিখতে শুরু করেছি প্রথম রিপোর্টাজ ‘সিঙ্গাপুরের পথে পথে’। ভাবখানা তখন এমন, দেশে রিপোর্ট লেখার সময়ও বিয়ারে গ্লাস ভরিয়ে নিয়ে বসি আর কী!
প্রথম রিপোর্টাজ সিঙ্গাপুরে পরিচিত বাংলাদেশি এক ছেলেকে নিয়ে। সে তাঁর প্রথম প্রবাস জীবনের গল্প বলতে বলতে বলেছে দেশের মতো সে সিঙ্গাপুরেও ফেনসিডিল খেতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। তার তখন কুড়ি হাজার ডলার জরিমানা অথবা লুথানের আদেশ-জেল হয়। লুথান মানে বেত মারা!
তার বাবা দেশ থেকে কুড়ি হাজার ডলার নিয়ে এসে আদালতে জমা দেয়ায় তার আর জেলে যেতে হয়নি। ছেলেটি আমাকে বলেছিল বাবা যে কুড়ি হাজার ডলার নিয়ে এসেছিল এতে বাবার খুব একটা ক্ষতি হয়নি! কারন যাবার সময় তিনি অনেক গোল্ডের বার নিয়ে গিয়েছিলেন!