কুকুরের কান্না

মানুষের পরেই কুকুর প্রাণীটার প্রতি আমার আলাদা এক ধরণের টান আছে। কুকুরদের কষ্ট দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। অবশ্য সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হয় মানুষের কষ্ট দেখলে বিশেষকরে বাচ্চা-কাচ্চাদের।

ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়িতে পোষা কুকুর এবং বেড়াল ছিল যারা একই পাত্রে খাবার খেত! সাধারণত কুকুরের আর বিড়ালের কখনই পড়ে না সে কারণেই হয়তবা “ঝুম বৃষ্টির” ইংরেজি “cats and dogs”. কিন্তু আমাদের বাড়ির কুকুর আর বেড়ালের যুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই এবং সেই কুকুরটা ছিল আমার নিত্যদিনের খেলার সাথি। আমাকে সে দেহরক্ষির মত অনুসরণ করতো। আমি যেখানেই যেতাম সেও সেখানেই যেতো। একবারের কথা বিশেষকরে মনে আছে। সালটা হবে হয়তো ১৯৮৮, প্রলয়ঙ্করী বন্যাতে আমাদের গ্রামের পথঘাটা সব ডুবে গেছে। সামান্য কিছু উচু যায়গা জেগে ছিল, যেমন ঘরের মেঝে, খড়ের পালা দেয়ার যায়াগাটা, ধান মাড়াইয়ের খোলাটা। একদিন দেখি একটা বিশাল সাইজের ইঁদুর পেছন দিকটা গর্তের বাইরের দিকে রেখে তার গর্ত থেকে বের হচ্ছে আবার গর্তে ঢুকে যাচ্ছে।

আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো। আমি সুযোগ বুঝে ইদুরটার লেজ ধরে তাকে গর্তের বাইরে নিয়ে আসলাম। যেভাবে বাচ্চারা স্কুলে বিস্কুট দৌড়ের সময় লাফিয়ে লাফিয়ে বিস্কুট ধরার চেষ্টা করে ঠিক সেভাবেই আমাদের কুকুরটা আমার হাত থেকে ইদুরটাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকলো। এক পর্যায়ে সফলও হলো কিন্তু ওর দাঁতের সামান্য কামড় আমার বা হাতের বুড়ো আঙুলে লেগে যায়। বেশ কয়েকেদিন ব্যাপারটা আমি গোপন রেখেছিলাম কিন্তু পরে লোকজনের কাছ থেকে কুকুরে কামড়ানো রোগীদের ভোগান্তির গল্প শুনে দাদিকে বলে দিলাম। যাদেরকে কুকুরে কামড়ায় তারা না কি পানি দেখলে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কারণ পানি খেতে গেলেই না কি তারা পানির মধ্যে কুকুরের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। শেষমেশ তারা পানি না খেতে পেরে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এমন আরো অনেক গল্প প্রচলিত ছিল।

এরপর শুরু হলো আমার চিকিৎসা। বাড়িতে একজন ডাক্তার থাকার সুবাদে আমাকে কবিরাজি চিকিৎসা না দিয়ে ডাক্তারি চিকিৎসা শুরু হল। তবে কবিরাজি চিকিতসার বর্ণনাটা দিয়ে রাখতে চাচ্ছি। থালা-পড়া বলে একটা চিকিৎসা ছিলো। যেটাতে কুকুরের কামড় খাওয়া রোগিকে সকাল সকাল খালি পেটে কবিরাজের কাছে যেতে হত। কবিরাজ তাকে সূর্যের দিকে মুখ করে বসিয়ে মন্ত্র পড়ে একটা কাঁসার থালা রোগির পিঠের সাথে লাগিয়ে দিতেন। ধারণা করা হত যতক্ষন কুকুরের বিষ রোগীর গায়ে থাকবে ততক্ষন থালাটা তার শরিরে লেগে থাকেবে। বিষ নেমে গেলে থালাটাও পিঠ থেক খসে পড়বে। কুকুরের বিষ নামানোর এই প্রক্রিয়াটা গ্রামে এখনও বহুল প্রচলিত। আর ডাক্তারি চিকিৎসাটা ছিল ভয়ংকর আতঙ্কের।

তলপেটে নাভির চারপাশে একে একে মোট ১৪টা ইঞ্জেকশন এবং সেটা দেয়ার কিছু পূর্ব প্রস্তুতি ছিল, যেমন সকালে খালি পেটে এই ইনজেকশন নিতে হত। বেশিরভাগ দিনই আমি কিছু না কিছু খেয়ে ফেলতাম আর মেজো আব্বা (মেজো চাচু) আমাকে রাম ধমক দিতেন। এইবার আসি ইঞ্জেকশন দেয়ার প্রক্রিয়াটাতে, সূচ ফোটানোর সময় পিপড়ার কামড়ের মত হালকা ব্যাথা অনুভব করতাম তারপর আর তেমন কিছু টের পেতাম না কিন্তু প্রক্রিয়াটা সেখানেই শেষ হয়ে যেত না। পেটের ঐ অংশে না কি চামড়ার অনেক স্তর বিদ্যমান তাই প্রতিটা স্তর ভেদ করে নির্দিষ্ট স্তরে পৌছাতে ইঞ্জেকশন দাতাকে অনেক কসরত করতে হত। আর ইনজেকশন দেয়ার পর জায়গাটা ফোড়ার মত ফুলে থাকতো। সেই ফোলা কমতে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ দিন লেগে যেত। পুরা ১৪টা ইঞ্জেকশনের কোর্স শেষ করার পর নাভিকে কেন্দ্র করে আমার পেটে একটা বৃত্তাকার ফুল তৈরি হয়েছিল।

কুকুরের মত হক আদায়কারী প্রভুভক্ত প্রাণী আমি এখন পর্যন্ত দ্বিতীয়টি দেখি নাই। আমাদের বাড়ি সারাক্ষণ অতন্দ্র প্রহরীর মত আগলে রাখতো। তাঁর চোখ ফাকি দিয়ে বাড়িতে একটা পোকা পর্যন্ত ঢুকতে পারতো না। আমার সেজো বড় আব্বার মেজো ছেলে রবিউল দাদাকে আমাদের এই কুকুরটা মোটেই সজ্য করতে পারতো না এবং ভবিষ্যতে এসে সেটা প্রমাণিতও হয়েছিল যে, সে আসলে খারাপ মানুষ। “কুকুররা কখনও মানুষ চিনতে ভূল করে না”।

কুকুরের আরো একটা গুনের পরিচয় পেয়েছিলাম ছোট বেলাতেই সেটা হল কুকুরের ঘ্রাণশক্তি। আমরা যখন শহরতলিতে বাড়ি করার জন্য প্রথমে নৌকা যোগে তারপর ভ্যান যোগে এরপর পায়ে হেটে আমাদের নতুন জায়গায় পৌছেছিলাম দেখি আমাদের পোষা কুকুরটাও আমাদের পেছন পেছন আমাদের বাড়িতে পৌছে গেছে। নৌকাতে সে আমাদের সাথেই ছিল কিন্তু বাকী ৫/৭ কিলোমিটার পথ সে কিভাবে আমাদেরকে অনুসুরন করেছিল সেটা এখনও আমার কাছে এক বিরাট রহস্য। এরপর আবার সে আমাদের আগের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল আব্বার সাথে একইভাবে।

আমাদের পাড়াতে আমার এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে একটা কুকুর ছিল ওকে ওরা টমি বলে ডাকতো। এই কুকুরটার সাথে ঠিক কবে থেকে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল সেটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও মনে আছে আমি যতদিন পরেই হোক না কেন আর যখনই হোক না কেন বাড়িতে ফিরতাম সে কিভাবে যেন সেটা টের পেয়ে যেত এবং আমার পায়ের কাছে এসে লেজ নাড়তে নাড়তে কুই কুই করে এক ধরণের শব্দ করতো। ওর আচরণ দেখে আমার মনে হত যেন সে বলতে চাইতো এইবার এত পরে এলে কেন?

গ্রামে কুকুরের কান্নাকে খুবই অমঙ্গলের বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কারণ গ্রামে কোন অশুভ ব্যাপার ঘটতে চললে কুকুররা না কি সবার আগে টের পেয়ে যায় এবং কান্না করে সবাইকে সাবধান করে দেয়। আগে বিশ্বাস করা হত প্রতিটি রোগ জীবানুই আসলে গ্রামে আসে মানুষের রুপ নিয়ে তাই মানুষ বুঝতে না পারলেও কুকুররা ঠিকই টের পায় এবং মানুষকে সাবধান করে দেয়। বিশেষ করে হাম-বসন্ত এবং কলেরা রোগের ক্ষেত্রে এটাকে বেশি মানা হত। আসল ব্যাপারটা আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে শীতকালে শীতের প্রকোপ ব্যাচারা কুকুর আর সহ্য না করে কান্না করে।

ঢাকাতে এসে মানুষের দূর্দশা দেখে কাতর হওয়ার পাশাপাশি কুকুরদের দূর্দশাও আমাকে কাতর করেছিল খুবই। আমাদের বাসা ছিলো উত্তরখানে, সেখানে এখন পর্যন্ত গ্রামের পরিবেশ বিদ্যমান। এখানে পাড়াতে বেশ কিছু কুকুর আছে, তাঁর মধ্যে আছে একটা মা কুকুর। তাঁর মোট তিনটা বাচ্চা, তাহিয়া এই বাচ্চাগুলোকে দেখলেই বলে, বাবা একটু আদর করে দেই আমি আর না করি না। সে পরম মমতায় ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেই।

আমরা প্রায়ই প্রভাত ফেরিতে বের হয়, যদি কুকুরটার সাথে দেখা হয়ে যায় আমি আর তাহিয়া মিলে ওর জন্য কখনও চিতই পিঠা, কখনও পাউরুটি কিনে খেতে দেই। এমনকি নাস্তার সময় লুকিয়ে আমরা তিন তলার বারান্দা থেকে পরটা ফেলে দিয়ে মুখে এক ধরণের চুক চুক শব্দ করলেই সে লেজ লেজ নাড়তে নাড়তে এসে সেটা খেয়ে যায় এবং যখনই আমাদের সাথে রাস্তায় দেখা হয় সে বেশ কিছুদূর আমাদের পিছন পিছন আসে যদি কোন খাবার দেই। যখন একেবারে নিশ্চিৎ হয়ে যায় যে আজ আর আমাদের কাছে কোন খাবার নেই তখন আমাদের পিছু নেয়া ছেড়ে দিতো।

আমি ছোটবেলায় খুব কাছ থেক শকুন দেখেছি, শকুন নিয়ে অনেক গল্প গ্রাম বাংলায় প্রচলিত ছিল এখনও আছে বোধহয়, সেসব গল্প অন্য কোন দিন। সেই শকুন নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে রক্ষার জন্য এখন কত সংগঠন কত তহবিল গঠন হচ্ছে তাতে শকুনদের কোন উপকার হচ্ছে কি না আমার জানা নেই। কিন্তু কুকুররা কাকের সাথে মিলে ঢাকা শহরের যে পরিমাণ আবর্জনা হজম করছে প্রতিদিন তার কোন পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। তবে এই সকল উপকারী প্রাণীদের ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে শকুনের মতই পরিস্থিতির তৈরি হবে।