মেয়র বদর উদ্দিন কামরানের মৃত্যু সংবাদটি আমি পেয়েছি বেশ দেরিতে। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার সময়ের ব্যবধানের কারনে ঘুম থেকে জেগে দেখি পুরো ইনবক্স মেয়র কামরানের জন্যে কান্নায় ভারাক্রান্ত।
কিন্তু তিনিতো এখন আর সিলেটের মেয়র নন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি সিলেটের মেয়রও নন। গত দুটি নির্বাচনে পরপর তিনি জিততে পারেননি। হযরত শাহ জালালের(রঃ) শহর সিলেটের দখল নানান হিসাব নিকাশ আছে।
কিন্তু সিলেটের বদর উদ্দিন কামরান আর চট্টগ্রামের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এই দুটি নামের সঙ্গে ‘মেয়র’ শব্দটি সমার্থক অথবা তা তাদের নামের অংশ হয়ে গিয়েছিল। মুজিবকোটের সঙ্গে গোলটুপিও মাথায় নিতে হয়েছে সর্বক্ষনিক।
মানুষের মনের মেয়র হয়ে ওঠার কারনে মেয়র মহিউদ্দিন অথবা মেয়র কামরান ছাড়া নাম দুটি ধরে ডাকতে শুধু তাদের শহরের মানুষেরা নয়, সারা বাংলাদেশে, এমনকি বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে যেখানে আছেন তারাও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন!
১৯৭৩ সালে ছাত্র থাকার সময় কামরান প্রথম জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশন মেয়র সব হয়েছেন। আর কিছু আর হতে হবেনা। জীবনে কখনও তিনি বিশ্রাম পাননি অথবা নেননি।
এমন একজন নেতা করোনায় আক্রান্ত শুনে বিচলিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত এয়ার এম্বুলেন্স পাঠিয়ে তাঁকে ঢাকার সিএমএইচে নিয়ে আসেন। এখানেই প্রথম তাঁর বিশ্রামের সুযোগ হয়। এখনতো তাঁর বিশ্রাম ছাড়া আর কোন কাজে নেই।
এখন তিনি সিলেট শহরের মানিক পীরের টিলায় চিরঘুমে। সিলেটের এই মানিক পীরের টিলার চূড়া পর্যন্ত যারা গেছেন, প্রথমবার তারা টের পেয়েছেন সিঁড়ি ভেঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এর পথ যেন আর শেষ না হয়।
হযরত শাহ জালালের (রঃ) এর সঙ্গে ধর্মপ্রচারে ৩৬০ আউলিয়ার সঙ্গে সিলেট এসেছিলেন এই মানিক পীরও। তাঁর সমাধিকে কেন্দ্র করে শহরের মাঝখানের এই টিলার নাম হয়ে গেছে মানিক পীরের টিলা।
আমাদের বন্ধুদের সিলেট নিয়ে গেলে আমি মানিক পীরের টিলাও দেখাতে নিয়ে যেতাম। কারন সেখান থেকে সিলেট শহরটা তখন অনেক সবুজ-সুন্দর দেখাতো। সবাই যার যার শহর দেশটাকে সুন্দর দেখাতে চায়।
আরেকজনের কাছে নিজের শহর দেশ সুন্দর করে দেখাতে উপস্থাপন করার আরেক সমার্থক সংজ্ঞার নামইতো দেশকে ভালোবাসা। মানিক পীরের টিলাটি এখন সিলেট শহরের অন্যতম কবরস্থানের জন্যেও স্বনামখ্যাত।
হযরত শাহ জালাল (রঃ), হযরত শাহপরানের(রঃ) মাজার দুটিকে বাংলাদেশের মোটামুটি সবাই চেনেন জানেন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় তীর্থস্থান ছাড়াও অনেকে বিপদে পড়লে মুশকিল আসানের আশায় এখানে ছুটে আসেন।
দেশের প্রধান রাজনীতিকরা নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন এই দুই মাজার জিয়ারত করে। অথবা দুই মাজার জিয়ারত করে তারা শুরু করেন তাদের সিলেট সফর। এখন থেকে অনেকে সিলেট এলে মানিক পীরের টিলায়ও জিয়ারতে আসবেন।
কারন এখানে এখন মেয়র কামরানেরও কবর আছে। তাদের অনেক ঋন আছে এই মেয়র কামরানের কাছে। আমি বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জে জন্ম নিয়ে একজন সাংবাদিক গড়ে বেড়ে ওঠায় সিলেটের অনেকের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।
সিলেট ভিত্তিক জাতীয় নেতাদেরর অনেকের সঙ্গে একটি ব্যক্তিগত ভালোবাসারও সম্পর্ক ছিল। দেওয়ান ফরিদ গাজী, আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শাহ এস এম এস কিবরিয়া, সাইফুর রহমান, এরা আমাদের সময়ের সিলেট অঞ্চলের মহিরুহ নেতা। ফজলুল বারীকে তারা অনেক স্নেহ করতেন।
একবার নেত্রকোনার কোন একটি উপ নির্বাচনে ঢাকা থেকে রিপোর্ট করতে গেছি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সেখানে প্রচারে অংশ নিতে গেছেন। হোটেলে দেখা করতে গেলে টেনেহিঁচড়ে তাঁর সঙ্গে ভাত খাওয়াতে বসালেন।
লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। দাদা পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘শরম করিওনা ফজলুল বারী। উই ফিল প্রাউড ফর ইউ। তুমি বহুত বালা রিপোর্ট করো। জানোতো সিলোটোর সাংবাদিক ঢাকাত কম’।
ওই বয়সে এমন নেতাদের সার্টিফিকেট পেতে ভালোবাসা পেতেই ভালো লাগতো। বাবরুল হোসেন চৌধুরী বাবুল, আখতার হোসেন, সদরউদ্দিন চৌধুরী এদেরও পরের টায়ারের নেতা বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান।
কুলাউড়ার গিয়াস উদ্দিন আহমদ, সিলেটের লোকমান আহমদদের হাতে আমরা রাজনৈতিক ভাবে গড়ে উঠেছি। এরশাদ আমলে যখন সিলেট জেলে যাই তখন আমাদের টিমে সবচেয়ে সিনিয়র নেতা ছিলেন সিপিবির আব্দুল হামিদ ভাই।
কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় এসে সিলেট গেলে একবার হলেও যার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম তিনি মেয়র কামরান ভাই। মেয়রের সঙ্গে দেখা করা নিয়েও কোন আমলাতান্দ্রিকতাকে তিনি কখনও গড়ে উঠতে দেননি।
২০০৫ বা ২০০৬ সালে সর্বশেষ আমি সিলেটে রিপোর্ট করতে যাই। কামরান ভাই তখন মেয়র। বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তখন ওয়ার্ড কমিশনার। কিন্তু সাইফুর রহমান মেয়রকে এড়িয়ে কমিশনার আরিফকে দিয়ে নানা কাজকর্ম করাচ্ছিলেন।
এটি নিয়ে গড়ে ওঠা দূর্নীতির চক্র নিয়ে রিপোর্ট করা ছিল আমার এসাইনমেন্টের অন্যতম অংশ। মীরা বাজারের একটা হোটেলে আমি উঠেছিলাম। রিপোর্টের জন্যে কামরান ভাই, আরিফ ভাইর সঙ্গে কথা বলা জরুরি ছিল।
সিলেটে তখন রিপোর্ট গেলে যানবাহন সংকটে জেরবার হতে হতো। ‘ও ড্রাইভার যাইবায়নি বলন দিমু যাইবায়নি’ বলে বলে রিকশা যোগাড় করা কঠিন ছিল। কিন্তু কামরান ভাই, আরিফ ভাই আমার সঙ্গে কথা বলতে হোটেলে চলে আসায় সে বার সেই পরিবহন সংকটে পড়তে হয়নি।
ফজলুল বারীকে তারা সবাই এমন ভালোবাসতেন। রিপোর্টার হিসাবে আমার একটি সমস্যা অথবা যোগ্যতা বেশিরভাগ সোর্সের সঙ্গে সম্পর্ক এক পর্যায়ে ভালো থাকেনা। কারন রিপোর্ট সত্যনিষ্ট করতে গেলে তা কারও পক্ষে অথবা বিপক্ষে যাবে।
আমার একটা রিপোর্ট কামরান ভাইর সঙ্গেও আমার সে রকম একটি সমস্যা হয়েছে। তবে এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার অবশ্য কখনও কোন আলাপ হয়নি। তা প্রকাশ পেয়েছিল সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক চৌধুরী মমতাজ আহমেদের এক রিপোর্টে।
সেই প্রিয় মেয়র কামরান ভাই আজ সবকিছুর উর্ধে। করোনা মহামারী বাংলাদেশে এখন কতটা আগ্রাসী হয়ে উঠছে তা প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে। মেয়র কামরান সেই জাতীয় ক্ষতির কান্নার তালিকায় অশ্রু দিয়ে লেখা তেমন আরেকটি নাম।
এমন একজন মাটির মানুষ মানুষের মনের মেয়রের শেষ সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সমর্থন দিয়েছেন এরজন্যে সিলেটের মানুষ কৃতজ্ঞ থাকবেন সারাজীবন। কিন্তু মেয়র কামরানের মৃত্যু নতুন আরেকটি আতংকের কারন হতে পারে।
করোনা মহামারী এখন প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে নানান চেহারা প্রকাশ করছে। এর মরনঘাতী নতুন চেহারাটি হলো শেষ রাতের দিকে হঠাৎ একজনের অবস্থার অবনতি ঘটছে এবং অবশেষে জানা যাচ্ছে তিনিও শেষ।
মানুষের মনের মেয়র কামরানের মৃত্যু সংবাদ সিলেটকে শোকার্ত করেছে, সতর্ক করবে কী? স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে যে সংখ্যায় মানুষ তাঁর জানাজা-দাফনে অংশ নিয়েছেন, তা দেখেশুনে ভয় করেছে।
সবাই সাবধান হোন প্লিজ। এই অবিশ্বাস্য মৃত্যু আবারও মনে করে দিন এই মহামারী মেয়র মানেনা, সিএমএইচ মানেনা, অধ্যাপক-ডাক্তার-পুলিশ-সাংবাদিক কাউকে মানেনা, পরোয়া করেনা।
তাঁর শহরের এখনকার বিএনপির মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তাঁর জন্যে শোক কর্মসূচী ঘোষনা করেছেন। নগর ভবনে খোলা হয়েছে শোকবই। কিন্তু আমিতো বহদূরে। তাই এই অনলাইনে লিখলাম এই শোকলিপি। ভালো থাকবেন মানুষের মনের মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ভাই।