শক্তহাতে দমন করুন পরিবহন ধর্মঘট

আল্লাহর ওয়াস্তে যেন চলছে একটা দেশ! সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানেন সড়ক নিরাপত্তা আইন কার্যকর করতে গেলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বাধা আসবে। কিন্তু এই বাধা কী করে সামাল দেয়া হবে সে নিয়ে কোন প্রস্তুতি পরিকল্পনা নেই! উনাদের শ্রমিক লীগ থেকে শুরু করে নানান সেক্টরে শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন আছে কাগজেপত্রে। পরিবহন সেক্টরের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাফিয়া নেতা শাহজাহান খানও তাদের সঙ্গে। রাঙা নামের জাতীয় পার্টির আরেক মাফিয়াও আছেন! ইনাদের তাহলে কাজ কী? শুধু ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খাওয়া আর লুটপাট করা? যে ছাত্ররা সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করলো তারা এখন কোথায়? এই আইন বাস্তবায়নে তাদের সহযোগিতা কী চাওয়া হয়েছে? না শুধু একটি দূর্ঘটনা ঘটলে সেটি নিয়ে শুধু রাস্তায় নামা তাদের কাজ? না নতুন আইনে পথচারীদের জন্যেও যে জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখে তারা এবং তাদের আব্বু-আম্মুরাও ভীতসন্ত্রস্থ? ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ-মহিলা আওয়ামী লীগ-যুব মহিলা লীগ-কৃষক লীগ, এত লীগের কাজ তাহলে কী? মানুষের পক্ষে যদি এরা দাঁড়াতে না পারে এত সব লীগ, তাদের বর্ণাঢ্য সম্মেলনের আউটকামটা কী? না ভোগান্তিতে পড়া মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো এদের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মধ্যে পড়েনা?

সরকারি দলের মেয়র সহ নানান নামের জনপ্রতিনিধি প্রায় সব স্থানীয় সংস্থায়। বিরোধীদলগুলোর জনপ্রতিনিধিও আছেন এলাকায় এলাকায়। তাদের ভোটারদের জিম্মি করে ফেলেছে সড়ক মাফিয়ারা! এই জিম্মি ভোটারদের জন্যে তাদের কী কারও কোন দায় নেই? হঠাৎ পরিবহন ধর্মঘটে যে যেখানে ভোগান্তিতে পড়েছে তাদের জন্যে জরুরি সেবার ব্যবস্থা করা কী জনপ্রতিনিধির দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা? ভোটের আগেতো একেকজন পা ধরা বাকি রাখেননা! এরপর সব শুয়রের বাচ্চা-কুত্তার বাচ্চা হয়ে যায়! সরকারি দলের বাইরের যত রাজনৈতিক দল তাদের কেউ কী সড়ক নিরাপত্তার পক্ষে না? না জবরদস্তিমূলক পরিবহন ধর্মঘটে সরকার, দেশের জনগন নাজেহাল হচ্ছে দেখে তারা বেশ মউছে আছেন? অদ্ভূত আমার জন্মভূমি।

অথচ এই দেশটি থেকেই যারা আমরা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছি, রেমিটেন্স পাঠাচ্ছি দেশে,  তারা জানি কিভাবে আইন মেনে পথে নামতে হয়। কোথাও কারও এই আইন মানিনা বলার কোন সুযোগ নেই। এই পরিবহন শ্রমিকদেরও অনেকে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে যান। সেখানে কী কারও দেশটির আইন নিয়ে দ্বিতীয় কোন উক্তি করার সুযোগ আছে? নতুন একটা ছাত্র পড়তে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায়। এখানে পৌঁছার প্রথম দিনেই পথ পেরুবার সবুজ বাতি জ্বলার আগেই বাংলাদেশের অভ্যাসে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছিল। সামনে এসে দাঁড়াল পুলিশের এক সদস্য। হাই জেন্টেলম্যান হাও আর ইউ বলে জানতে চাইলো এভাবে সে রাস্তা কেনো পেরিয়েছে। এরপর তার ফোন নাম্বার বাসার ঠিকানা নিয়ে ধরিয়ে দিলো ৬৯ ডলার জরিমানার টিকেট। বললো জরিমানার চিঠি বাসায় পৌঁছে যাবে। সে যেন তা অনলাইনে বা কোন পোষ্ট অফিসে গিয়ে তা পরিশোধ করে দেয়। আর এমন ভুল যেন না করে। অস্ট্রেলিয়ার জীবনের প্রথমদিনের এই স্মৃতি এই ছেলেটি কোনদিন ভুলতে পারেনি। এই অপরাধও করেনি দ্বিতীয় কোনদিন। বিশ্বের দেশে দেশে সড়ক নিরাপত্তা আইনের কড়াকড়ির কারন কেউ যাতে এই অপরাধ দ্বিতীয়বার না করেন।

নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইনের প্রতিবাদে বিনা নোটিশে ধর্মঘটে যাওয়া শ্রমিকরা বলছেন এত মোটা অংকের জরিমানা না দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা যারা অস্ট্রেলিয়ায় আছি, জরিমানা দিতে আমাদেরও ভালো লাগেনা। একেকটি জরিমানা সাড়ে তিনশ-চারশ ডলার শোধ করতে গেলে সপ্তাহের বাজেটে টান পড়ে। এদেশের বেশিরভাগ লোক, বিশেষ করে ছাত্রদের সাপ্তাহিক আয় সাড়ে তিনশ-চারশ ডলারের বেশি নয়। সে কারনে সবাই এমন সতর্কভাবে চলেন যেন জরিমানা দিতে না হয়। অস্ট্রেলিয়ায় নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে আমরা যারা থাকি তাদের বাসে-ট্রেনে-ফেরিতে ভ্রমনের সময় ওপাল কার্ড নামের একটি কার্ড ব্যবহার করে চলতে হয়। কার্ডে থাকতে হয় পর্যাপ্ত পরিমানের টপআপ রিচার্জ। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার পথে কার্ডটি স্পর্শ করলে গেট খুলে যায়। প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার যাবার পথটি সব সময় খোলা থাকে। অনেকে তাড়াহুড়ায় টাচ পয়েন্টে টাচ না করে বা ভুল করে টাচ ছাড়াই ওইপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে ওঠেন। ওই অবস্থায় ট্রেনের কার্ড চেকার কারও কার্ড টাচ ছাড়া পেলে স্পট ফাইন দু’শো ডলার। এরজন্যে এমন ভুল কেউ দ্বিতীয়বার করেননা।

কারন দু’শ ডলার আয় করতে যে কত কষ্ট তা এখানকার লোকজন জানেন। শেয়ারের রূমে থাকলে দু’শ ডলারে একজনের সাপ্তাহিক বাসা ভাড়া-খাবারের টাকা হয়ে যায়। এদেশে এমন পথে পথে শুধু ফাইন আর ফাইন। সে কারনে দেশ থেকে যারা বেড়াতে আসেন তাদের আমরা মজা করে বলি, এখানে রাষ্ট্র সারাক্ষন আমাদের পিছনে বেত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই বেতটির নাম ফাইন। বাংলাদেশে এখনও লোকজন পথেঘাটে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে প্রস্রাব করেন। এরজন্যে পাবলিক নুইসেন্স আইনে আমাদের স্পট ফাইন ঠিক করা আছে দু’শ ডলার। পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বাড়ালে ফাইনের পরিমান বাড়বে। আমাদের এখানেও পথেঘাটে যত্রতত্র পাবলিক টয়লেট নেই। সে জন্যে ঘর থেকে বেরুবার আগে বা স্টেশনে-শপিং মলে মনে করে এ কাজটি সেরে রাখতে হয়।

ধর্মঘটি একজন ট্রাক চালক বলছিলেন অত টাকা জরিমানা-জেল দন্ড মাথায় নিয়ে তিনি এ কাজ করতে পারবেননা। ঠিক আছে উনি যদি করতে না চান করবেননা। আরেকজনের পথ আটকাবেন কেনো? কাউকেতো কোন কাজ করতে কেউ হাতে পায় ধরেনি। এমনতো নয় যে আপনি এ কাজ না করলে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। জীবিকার জন্যেই আমরা বিদেশে নানা কাজ করি। কিন্তু কাজটি করতে হবে আইন মেনে। আইন করবে আইনসভা। আইন বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্র। আমার কথামতো বা সুবিধামতো আইন নাও হতে পারে। সবার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্র যে আইনের কথা বলবে তা আমাকে মানতে হবে। আমি যদি না মানি তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহ।

ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রীকে পথে এমন পিষে মেরেছে কোন একজন চালক। এমন হত্যাকান্ড যে চালক ঘটান তার জামিন অস্ট্রেলিয়াতেও হয়না। কারন সব চালক যেমন দূর্ঘটনা ঘটায়না, এমন মানুষ হত্যাকারী চালক জেলের বাইরে থাকা যে কারো জন্যে বিপদজ্জনক। পরিবহন দূর্ঘটনায়তো পরিবহন শ্রমিক-তাদের পরিবারের সদস্যরাও মারা যান, হাত-পা হারান। কিন্তু তখন তারা কী এর বিচার চান না? স্ত্রী হত্যার বিচার চেয়ে সবার জন্যে একটি নিরাপদ সড়ক চেয়ে,  ইলিয়াস কাঞ্চন একটি ব্যতিক্রমী জনআন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এটা না করে বেদের মেয়ে জ্যোস্নার মতো সুপার ডুপার হিট ছবির নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন যদি অভিনয় অথবা ব্যবসায় লেগে থাকতেন তাহলে তিনি অর্থনৈতিকভাবেও অনেক স্বচ্ছল ভালো থাকতেন। নতুন আইনের কারনে দেখলাম পরিবহন শ্রমিকরা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতাপেটা করছেন!

 ইলিয়াস কাঞ্চন কী এমপি? তিনি কী আইন করেছেন? না আইন করেছেন এমপিরা, তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা? আইনটা নিয়ে এতো ক্রোধ! সাহস থাকলে শেখ হাসিনার ছবির দিকে জুতাপেটার দরকার নেই, জুতোটা তাক করে ছবি তুলে কী হয় একটু ট্রাই করবেন হে বীর(!) আন্দোলনকারীরা? তাদের এটা আন্দোলন নয়। সড়ক নৈরাজ্য অব্যাহত রাখার লাইসেন্স দাবি করে দেশের মানুষকে-একটা সরকারকে জিম্মি করার মতো ধৃষ্টতা। দুনিয়ার যত দেশে পথ নিরাপদ হয়েছে এমন আইনের কড়াকড়ির কারনে হয়েছে। যে আইনকে কেউ ভয় পায় না সে আইন কখনো কার্যকর হয়না। বিদেশে আমরা জানি আমাদের যদি ড্রাইভিং লাইসেন্সই না থাকে আমরা কাজই পাবোনা। কাজ না পেলে নিজে চলতে পারবোনা দেশে টাকা পাঠাতে পারবোনা। দেশে টাকা পাঠাতে না পারলে গ্রামের বাড়ির উনুনে চুলো জ্বলবেনা। সে কারনে সারাক্ষন জরিমানা-ড্রাইভিং ডিমেরিটস পয়েন্টের ভয়ে থাকি। কারন একটি পয়েন্ট হারালে সেটি ফেরত আসবে তিন বছর চারমাস পর। হাতের ১৩ টি পয়েন্ট হারালে তিন বছর চার মাস গাড়ি চালাতে পারবোনা। এখানে যেহেতু ড্রাইভিং না করতে পারলে কোন ভালো জব নেই তখন বাক্সপোটরা গুটিয়ে দেশে চলে যেতে হবে। দেশে যারা আছেন তাদেরই জব নেই আমরা দেশ ফিরলে আমাদের জব দেবেন কোত্থেকে?

এত কিছু লেখার কারন সরকারকে অনুরোধ সড়ক নিরাপত্তা আইনের প্রশ্নে কোন আপোষ করবেননা। দেশের পথ যদি নিরাপদ না করতে পারেন কোন উন্নয়ন টেকসই হবেনা। আর কথায় কথায় মানুষকে জিম্মি করার গণতন্ত্র বন্ধ করতে হবে। একজনের ধর্মঘট করার অধিকার আছে। কিন্তু একজন যদি ধর্মঘট করতে না চায় তার পথ আটকানো এটা গণতন্ত্র নয়। জুলুম। গুন্ডামি। গণতন্ত্র আর গুন্ডামিকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেননা। আমি যদি দেশের ক্ষমতায় থাকতাম যত বেশি সম্ভব ছেলেমেয়েকে ড্রাইভিং’এ দক্ষ করে তুলতাম। কেউ একজন ড্রাইভিং’এ দক্ষ-আইনানুগ হয়ে উঠলে তার জীবন বদলে যায়। গতিশীল হয়ে ওঠে। এমন দক্ষ-আইনানুগ চালকদের কাজে লাগিয়ে বদলে দেয়া সম্ভব বাংলাদেশকে। তখন এসব সড়ক গুন্ডাদেরও জব্দ করা সম্ভব। যাও বাবা যত ইচ্ছা ধর্মঘট করো। কিন্তু কারও পথ বন্ধ করা যাবেনা। প্রয়োজনে এই পথ গুন্ডামি বন্ধে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগান। আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসংঘ বাহিনীতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের পথ নিরাপদ করার কাজও করে। প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্লিজ, এই আইন কার্যকরের প্রশ্নে যাতে কোন আপোষ করা না হয়।

fazlulbari2014@gmail.com