আইসিসির নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে এখন সাকিব সাকিব মাতম চলছে। এটি খুব স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়া। কারন সাকিবকে দেশের মানুষ শুধু ভালোবাসেনা, বিদেশে সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেট পোস্টারও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের চলতি দাপুটে পদচারনার অনেক কিছু সাকিবের কারনেও। আইসিসির ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার বাংলাদেশের সাকিব। তাঁর নায়কের আসনটি আপাতত ভূপাতিত। সাকিব বিষাদটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও। সিডনির কিছু সাকিব ভক্ত এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি তাদের বুঝিয়েছি। কারন আমরা বিদেশের বিচার ব্যবস্থাটি জানি। এর গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কেউ দোষ স্বীকার করলে তার সাজা কম হয়। সাকিব তার দোষ স্বীকার করাতে তাঁর সাজা মূলত এক বছর হয়েছে। শাস্তি মেনে নিয়ে সাকিব এরমাঝে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এমসিসির ক্রিকেট কমিটি থেকে পদত্যাগও করেছেন।
বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের চরম দূর্যোগের খবরটি এমন সময় এসেছে যখন দেশের ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাকিবের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলোনা । বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের পছন্দ সবকিছুতে একজন ‘সহমত ভাই’, ‘আপনি সেরা ভাই’ ক্যাপ্টেন। এই বিবেচনা থেকেই মুশফিককে টেস্ট ক্যাপ্টেনসি থেকে সরিয়ে সাকিবকে ক্যাপ্টেন করেন বিসিবি বস। কিন্তু দেশের ক্রিকেটদলের ইতিহাস হচ্ছে সাকিব নিজে খেলেন ভালো, কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসাবে তিনি কতোটা ভালো তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বৈষয়িক বুদ্ধিমান সাকিব সব সময় বোর্ডের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় চলছিলেন। কিন্তু সাকিবের নেতৃত্বে ক্রিকেট বিদ্রোহকে বেয়াদবি হিসাবে দেখেন বিসিবি বস। এটিকে তিনি ভারত সফর বাতিল-দেশের ক্রিকেটকে ধংসের ষড়যন্ত্র হিসাবেও বলার চেষ্টা করেন। সামনে ভারত সফর, অথচ ‘খেললে খেললো না খেললে নেই’ জাতীয় একটি আত্মঘাতী মন্তব্যও তিনি করেন! কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পরই বদলে যান পাপন। গণভবন থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ন ঘুরে গিয়ে বলেন, খেলোয়াড়রা ফিরলেই তাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে।
ক্রিকেটারদের আন্দোলনের সময় ‘ভারত সফর পন্ড’, ‘দেশের ক্রিকেটকে ধংসের ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বে খেলোয়াড়দের মধ্যে সাকিবকে ইঙ্গিত করেন বিসিবি বস। ঘরোয়া ক্রিকেটে পাতানো ম্যাচ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ‘সামনে আরও খবর পাবেন’! কারন ওই সময়েই তিনি সাকিবের ব্যাপারে আকসুর তদন্তের খবর জানতেন। শুধু তাই নয় এক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে হারের পিছনেও তিনি সাকিবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। নাজমুল হাসান পাপন বলেন সেই টেস্টের পিচ পছন্দ করেছেন সাকিব, আবার হারের পরে সে পিচকে দায়ী করেছে। ক্রিকেটার আন্দোলনের অবসানের পর গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তিকে কেন্দ্র করে সাকিবের সঙ্গে বোর্ডের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। নাজমুল হাসান পাপন ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেন, গ্রামীণফোনের সঙ্গে সাকিব যেটা করেছে এটা সে করতে পারেনা। সাকিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবারও ইঙ্গিতও দেন বিসিবি বস। ক্রিকেটে ব্যবস্থা মানেই নিষেধাজ্ঞা-জরিমানা। অর্থাৎ এখন আইসিসি সাকিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলেও ব্যবস্থা নিতো বিসিবি! কারন গ্রামীণফোন থেকে সাকিবের তিন বা পাঁচ কোটি টাকা অর্জনের বিপরীতে বিসিবির ১০০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা ভেস্তে যাচ্ছিলো।
ভারত সফরকে সামনে রেখে দু’দিনের অনুশীলনে সাকিব অংশ নেননি। অংশ নেননি একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচেও। কিন্তু এই সময়ে প্রতিদিন সাকিব বিসিবি অফিসে এসে বোর্ড সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মিডিয়াকে বলা হয়েছে অনুশীলনে অংশ না নেবার বিষয়ে কোচের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন সাকিব। বাইরে থেকে অনেকে মনে করছিলেন গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তির দ্বন্দ্ব মেটাতে বিসিবি বসের সঙ্গে কথা বলছেন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের ক্যাপ্টেন। কার্যত ওই সময়েই বিসিবি আইসিসির তদন্ত নিয়ে সাকিবের বক্তব্য জানতে চেয়েছে। বিসিবি আগে থেকেই জানতো আকসুর তদন্ত নিয়ে ৩০ নভেম্বর একটি আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি দেবে আইসিসি। কিন্তু সাকিবের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তখনই তারা প্রথম কথা বলে। আকসুর সঙ্গে এ নিয়ে সাকিবের ধারাবাহিক জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি নিয়েও এর আগে নিজের থেকে সাকিব কখনো নিজের দেশের বোর্ডকে জানাননি।
খুব স্বাভাবিক বিষয়টিকে পছন্দ করেননি বিসিবি বস। ক্রিকেটারদের আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেয়া, গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে এমনিতেই তিনি সাকিবের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন। এই সময়ে আইসিসির সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো হয়ে আসে। এখন আর সাকিবকে সাইজ দিতে হবেনা বিসিবির। গ্রামীণফোন নিজেরাই চুক্তি বাতিল করবে সাকিবের সঙ্গে। কিন্তু নাজমুল হাসান পাপনের প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ভাষা পরিবর্তিত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে। সাকিব যেহেতু জুয়াড়িদের প্রস্তাব গ্রহন করেননি তাই তার পক্ষে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। যে বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী রাসেলের বক্তব্যে। আজারবাইজান সফর থেকে ফিসংবাদ সম্মেলনেও একই কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। এরজন্যেই সাকিবের পাশে এভাবে দাঁড়িয়েছে বিরূপ একটি বোর্ড। সাকিবের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
সার্বিক পরিস্থিতির কারনে সাকিবের বিরুদ্ধে আইসিসির সিদ্ধান্তকে অনেকে বিসিবির তথা নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আদতে দুটি কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ন। একটির সঙ্গে আরেকটির কোন যোগসাজশ নেই। আকসু তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে জুয়াড়িদের প্রস্তাব গ্রহন করেননি সাকিব। কিন্তু এমন প্রস্তাবের বিষয়টি যে আকসু বা নিজের বোর্ডকে জানানোর যে আইন, সাকিব সে বিধি লংঘন করেছেন। আকসুর কিতাবে এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ। একবার নয়, তিনবার জুয়াড়িদের সঙ্গে সাকিবের যোগাযোগ হবার বিষয়টি শনাক্ত করেছে আকসু। কিন্তু হোয়াটআপও যে মনিটর হয় এই তথ্য কী জানতেননা সাকিব। এটি তাঁর মতো একজন ক্যারিয়ারিস্ট ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য।
আর সাকিবতো দেশের কোন জুনিয়র ক্রিকেটার নন। ১৮ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছেন। ক্রিকেটের সমস্ত আইনকানুন, আকসুর কার্যক্রম তাঁর মুখস্ত। আকসু কিভাবে খেলোয়াড়দের অনুসরন করে একজন ক্যাপ্টেন হিসাবে তিনি তা অনুজদের জানান সব সময়। বাংলাদেশে আশরাফুলের ঘটনার কথা সবাই মনে করতে পারেন। আশরাফুলের সেই ঘটনার আগে মাঠে তাঁর সঙ্গে সাকিব-তামিমের খারাপ ব্যবহার অনেকে পছন্দ করেননি। আশরাফুলের ঘটনার পর সাকিব-তামিমের প্রতিক্রিয়াও ইতিবাচক ছিলোনা। গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় হোটেলে রাতে দেরি করে ফেরাকে কেন্দ্র করে আকসুর প্রশ্নের মুখে আল আমিনকে দেশে ফেরত পাঠায় বিসিবি। ক্রিকেটারদের স্ত্রী থেকে শুরু করে বিশেষ ঘনিষ্ঠদের ফোনও মনিটর করে আকসু। সেখানে সাকিব জুয়াড়ির সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছেন! আবার হোয়াটআপের কথোপকথন ডিলিটও করেছেন! এ সব সাকিবের সঙ্গে মেলেনা।
কিন্তু সাকিব সবচেয়ে সৎ যে ভূমিকাটি দেখিয়েছেন তাহলো ভুল এবং দোষ স্বীকার করেছেন। এটি বিদেশে যে কারও শাস্তি কমায়। বাংলাদেশে কাউকে রিমান্ডে নিয়ে যে পিটিয়ে ডিম-ইলেক্ট্রিক থেরাপি নিয়ে যেভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়, উন্নত বিশ্বে তা নেই। নানাকিছুর প্যাথলজি পরীক্ষার প্রমান সহ প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত আটক ব্যক্তির সামনে তুলে ধরে বলা হয়, দোষ স্বীকার করলে এই শাস্তি দোষ স্বীকার না করলে এই শাস্তি। জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি আকসু বা দেশের বোর্ড না জানানোর দোষ স্বীকার করায় আইসিসি তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে তাঁকে কম শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু ভক্তহৃদয় এই শাস্তিও মানতে নারাজ। তাদের ধারনা সাকিব যেহেতু জুয়াড়ির প্রস্তাব গ্রহন করেনি তাই আইসিসি তাকে আরও কম শাস্তি অথবা অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে পারতো। সাকিবের ব্যাপারে আইসিসির সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশও দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রেও সুবিধা পাবার সুযোগ কম। কারন সাকিব দোষ স্বীকার করেছেন। আইসিসির আইনেও আছে তাদের এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করা যায় না।
সাকিবের ঘটনাটি দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি কষ্টের নাম হয়ে থাকবে। এরজন্যে সাকিবের মানসিক কষ্টের বিষয়টি বিসিবি বসের সঙ্গে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ পেয়েছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে সাকিবের বডিল্যাঙ্গুয়েজ যা দেখা গেছে তা দেশের মানুষের পরিচিত সাকিবের নয়। সৃষ্ট পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে তাঁর অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি এখনই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে যে সব পণ্যের বিজ্ঞাপনে সাকিব ছিলেন সেগুলোর প্রচার এরমাঝে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জগতের সব সম্পর্ক অর্থনৈতিক। সবাই একজন নায়কের পূজারি। ভিলেনের নয়। বিরূপ সময় রাতারাতি একজন সাকিবকে নায়কের আসন থেকে নামিয়ে বসিয়েছে ভিলেনের আসনে।
কিন্তু বড় এবং মূল ক্ষতিটি হয়ে গেলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের। কারন বিদেশে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারের নাম সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কটি বিশেষ ঘনিষ্ঠ। স্পন্সররা রাজি হননা বলে বলে ভারত-অস্ট্রেলিয়ায় সফর পায় না বাংলাদেশ। অনেক দিনের চেষ্টায় যখন ভারতে একটি ঐতিহাসিক সফর পাওয়া গেলো, এর আগ মূহুর্তে সাকিবকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তটি হয়েছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এখন সাকিব-তামিম বিহীন বাংলাদেশ দলের ভারত সফর হতে পারে কঠিন এক অভিজ্ঞতা। সাকিবের সৌভাগ্য সারা বাংলাদেশ তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সবাই তাঁর পক্ষে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে নজিরবিহীন। সাকিব আমাদের লড়াকু ক্রিকেটার। কাজেই এক বছর পরে হলেও আবার স্বমহিমায় ফিরে আসার সক্ষমতা সাকিবের আছে। এই এক বছর কোনভাবে কোন মিডিয়া বিতর্কেও জড়ানো ঠিক হবেনা সাকিবের। কেউ যেন সে অপচেষ্টাও না করেন। ফিরে আসুন বাংলাদেশের ভালোবাসার সাকিব। বাংলাদেশ আপনার অপেক্ষায়।