অ্যান্টনির স্ত্রী ফুলভিয়া তখন গ্রীসের এথেন্সের সরবরাহ ও পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত। আর অপেক্ষা করছেন স্বামীর। অ্যান্টনি তাকে চিঠি পাঠালেন, এখন যাতে তিনি কোনোভাবেই মিশর না আসেন।
কিন্তু ফুলভিয়ার ভাই তাঁকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে যাচ্ছিলেন। অ্যান্টনি ফুলভিয়া ও তার ভাই অক্টোভিয়ানকে রোমে পাবার একটি সুযোগ খুঁজছিলেন। ক্লিওপ্যাট্রাও তখন অ্যান্টনিকে আলেকজান্দ্রিয়ায় রেখে ভালোই করেছিলেন।
অ্যান্টনির প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ত ছিলেন ফুলভিয়া। ৩৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মার্ক অ্যান্টনি আর্মেনিয়া রাজ্যে নিজের জনমত গঠনের কাজে নামলেন। যা পরবর্তীকালে তাঁকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সাফল্য এনে দেয়।
পূর্বাপর বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দেশব্যাপী এমনকি আলেকজান্দ্রিয়াতেও উৎসবের আয়োজন করেন অ্যান্টনি। ক্লিওপ্যাট্রাকে নতুন মর্যাদায় তুলে ধরার মানসে অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি করা হয়।
অ্যান্টনিও প্রাচীন গ্রিক-রোমান শাসনের প্রতিভূ হিসেবে নিজেকে ‘নতুন ডিওনাইসাস’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এটিও ছিল তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন। কিছুদিনের মধ্যে আরো অনেক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, শিশু-উৎসব করলেন অ্যান্টনি।
যেখানে শিশুদের জন্য রাজকীয় উপাধি প্রদান এমনকি তাদেরকে রাজ সিংহাসনে তাদের নিয়ে বসারও সুযোগ দিলেন। এমন সব অবস্থার ভিতর খ্রিস্ট পূর্ব ৩২-৩১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফুলভিয়ার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান অ্যান্টনি।
এই ঘটনা সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে এটাই প্রমাণ করলো যে মিশর সুন্দরী ক্লিওপ্যাট্রার সঙ্গে আসলেই তাঁর প্রণয় রয়েছে। এতে করে রোমানদের সঙ্গে বিশ্বস্ততা, নির্ভরতা, সহযোগিতা এসব কিছুর ইতি ঘটলো মার্ক অ্যান্টনির।
ফুলভিয়াকে ডিভোর্সের ঘটনার পর তাঁর প্রকাশের উদ্যোগ নেন অ্যান্টনি। এদিকে খবর আসে সিংহাসনের নিরাপত্তায় জুলিয়াস সিজারকে বিয়ে করেছেন মিশর সুন্দরী। এতে করে বিক্ষুদ্ধ অ্যান্টনি ক্লিওপ্যাট্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।
আবার এ নিয়ে অনেকের মনে এমনও ধারণা হয় যে, সম্মিলিত শক্তিতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকেই বিশ্ব জয়ের যুদ্ধ শুরু করেন অ্যান্টনি। কিন্তু অক্টোভিয়ান নৌবাহিনীর কাছে তাঁর মর্মান্তিক পরাজয় ঘটে।
এর প্রতিশোধ নিতে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আবার আলেকজান্দ্রিয়া অভিযান শুরু করেন অ্যান্টনি। এবারেও তাঁর পরাজয় ঘটে। তখন নিজের তরবারি দিয়েই আত্মহত্যা করেন অ্যান্টনি।
বিশাল রোম সাম্রাজ্য-গ্রিস, ইতালি, মিশর আর আলেকজান্দ্রিয়া সব পিছনে পড়ে রইলো। এরপর ক্লিওপ্যাট্রার মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসে দুই ধরনের বক্তব্য আছে। একপক্ষ লিখেছেন অ্যন্টনির মৃত্যুর পর শাস্তি দেয়া হয় ক্লিওপ্যাট্রাকে।
তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় অক্টোভিয়ানের সামনে। ক্লিওপ্যাট্রাকে মারতে সেখানে আনা হয় চরম বিষাক্ত সাপ ‘অ্যাসপ’। এ সাপের আগের নাম মিসরীয় কোবরা। সেই কোবরাকে ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে আনা হয় ক্লিওপ্যাট্রার সামনে।
তখন সেই বিষাক্ত সাপের কামড়েই ৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১২ আগস্ট মৃত্যু হয় মিশর সুন্দরী ক্লিওপ্যাট্রার। আবার আরেকদল ঐতিহাসিকের মতে তখন আত্মহত্যা করেন মিশর সুন্দরী। রাজ্য হারানোর শোকে সেই সাপের ছোবলেই তিনি প্রান দেন।
সেই মৃত্যুতেও ক্লিওপ্যাট্রাকে নিয়ে রহস্য গল্পের শেষ হয়ে যায়নি। মিশরের ইতিহাসের শেষ ফারাও টলেমি রানী ছিলেন ক্লিওপ্যাট্রা। তাঁর একের পর এক দুর্বিনীত প্রেম রহস্যময় জীবন কাহিনী সম্ভবত কখনোই পুরনো হবে না।
এরপর থেকে গত দুই হাজার বছর ধরে যত মানুষ মিশরে আর আলেকজান্দ্রিয়ায় গেছেন তখনই সবারই একটাই জিজ্ঞাসা ছিল কবর কোথায় ক্লিওপ্যাট্রার। কোথাও শুয়ে আছেন মিশর সুন্দরী?
এটি নিয়ে আগ্রহ মিশর সরকারেরও। কারন তারাও জানে ক্লিওপ্যাট্রার সমাধি পাওয়া গেলে সেটি মিশরের আরেকটি দর্শনীয় স্থান হবে। সেটি দেখতে আরও বেশি পর্যটক আসবেন মিশরে।
এই সমাধির সন্ধানে প্রত্মতত্ত্ববিদরা এখন খনন চালাচ্ছেন টাপোসিরিস মাগনা উপসনালয় এলাকায়। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে এর অবস্থান। প্রত্মতত্ত্ববিদদের বিশ্বাস এখানেই সমাধি ক্লিওপ্যাট্রা আর মার্ক অ্যান্টনির।
২০০০ হাজার বছর ইতিহাসের আলোচিত দুই যুগলকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়ে থাকতে পারে। এরমাঝে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বেশকিছু নিদর্শন। এরমধ্যে ক্লিওপ্যাট্রার ছবি সম্বলিত ২২ টি ব্রোঞ্জ মুদ্রা রয়েছে।
আর আছে খাড়া নাকওয়ালা মুখোশ পরিহিত এক পুরুষের দেহের উপরের অংশ। মনে করা হচ্ছে এটিই মার্ক অ্যান্টনির আবক্ষমূর্তি। সারা বিশ্ব এখনও এই খনন কাজ সমাপ্তির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায়। সবাই যে ক্লিওপ্যাট্রার সমাধি দেখতে যেতে চায়।
ইতিহাসের এমন নানাকিছুর স্মৃতির গন্তব্য মিশরের এই আলেকজান্দ্রিয়া। মিশর রোমান দখলে চলে গেলেও আলেকজান্দ্রিয়ার মানমন্দির লাইব্রেরির নানান প্রভাব-প্রতিপত্তি নিমিশে মিলিয়ে যাবার ছিলোনা।
পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে গ্রেকো-ইজিপশিয়ান সভ্যতার ভাবধারা মিশর-আলেকজন্দ্রিয়ায় চালু ছিল। এর কারন একমাত্র খ্রিস্টান মৌলবাদীরা ছাড়া প্রাচীন কালের শাসকরাও বোধকরি এতোটা আক্রোশ মনোভাবাপন্ন ছিলেননা।
পুরনো রাজত্বের সংস্কৃতি যতটা ভালো লাগতো ততটা তারা গ্রহন করতেন। চর্চা বহাল রাখতেন। এসবের সমূলে বিনাশ করে দিতেননা। এখনও এর দৃষ্টান্ত আলেকজান্দ্রিয়া নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা।
যা কিছুর সর্বনাশ একমাত্র খ্রিস্টান মৌলবাদীদের হাতেই হয়েছে। রাজ্য দখলের পর খ্রিস্টান মৌলবাদীরা এখানে একজন নারী দার্শনিক হাইপেশিয়ারকে ধর্ষন ও হত্যা করেছিল।
তাদের হাতেই ধংস হয় সেরাপিয়াম ও সিজারিয়ন মন্দির সংশ্লিষ্ট লাইব্রেরি! কারন আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনায় প্যাগান মতাবলম্বীদের সংশ্লিষ্টতা পছন্দ করতোনা খ্রিস্টান মৌলবাদীরা।
চতুর্থ শতকের শেষের দিকে আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাগান মন্দিরগুলো তাদের হাতে ধংস হয়। গ্রেট আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি, এর প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ম্যুজিওন অফ আলেকজান্দ্রিয়া’ও তখন খ্রিস্টান মৌলবাদীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বিলুপ্ত হয়।
১১৫ খৃষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ পুড়ে যায় ইহুদী-গ্রীক যুদ্ধে। রোমান সম্রাট কারাকালার আদেশে আলেকজান্দ্রিয়ার স্থানীয় সব যুদ্ধ করতে সক্ষম তরুনকে হত্যা করা হয় ২১৫ খৃষ্টাব্দে!
৩৬৫ খৃষ্টাব্দের ২১শে জুলাই ক্রীট-ভূমিকম্প-সুনামিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আলেকজান্দ্রিয়ায়। চতুর্থ শতকে শেষে নব্য-খৃষ্টান রোমানদের হাতে ভয়াবহ আকার ধারন করে প্যাগান-নির্যাতন।
আলেকজান্দ্রিয়ার খৃষ্টিয় ধর্মীয় নেতা থিওফিলাস তল্লাটের সব সমস্ত প্যাগান মন্দির ধ্বংস করে ফেলেন। এদের দাপটে তখন ইহুদিরাও এলাকাটি থেকে পালিয়ে যায়। পরিত্যক্ত খালি হয়ে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার ব্রুকিয়াম নামে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও রাজকীয় গ্রীক মহল্লা।
ফেরাউনের স্মৃতি পিরামিড ভাঙ্গতে মুসলিম মৌলবাদীদের ব্যর্থ চেষ্টা দেখেছিল মিশর। আর আলেকজান্দ্রিয়া দেখেছে খ্রিস্টান মৌলবাদী তান্ডব। যা এখানে চলেছে আরব সেনাপতি আমর ইবনে আল-আসেরের আলেকজান্দ্রিয়া দখলের আগ পর্যন্ত।
আমর ইবনে আল-আসের আলেকজান্দ্রিয়া দখলের পর এখানে মিশরে মুসলিম যুগের সূচনা হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আধুনিক চিন্তার মুসলিম শাসকদের নেতৃত্বেই চলছে মিশর।
এই নেতৃত্ব দেশটির প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গৌরববোধ-গবেষনা করে। আয় করে পর্যটন থেকে। বিদেশে কখনও নিজেদের ফেরাউনের বংশধর অথবা ক্লিওপ্যাট্রার দেশের মানুষ পরিচয় দেয়।