নেতার স্বজনের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক কান্নাকাটি নিয়ে বাংলাদেশে অনেক গল্প চালু আছে। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মায়ের মৃত্যুর পর বেশি কান্নাকাটি করেছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ।
এরশাদের মায়ের মৃত্যুর পর কাজী জাফরের কান্না থামানো যাচ্ছিলোনা। কাজী জাফরের কান্না থামাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে এরশাদ শান্তনা দিয়ে বলছিলেন কান্দিসনারে জাফর। সবার মা’ই একদিন মারা যায়।
উত্তর কোরিয়ার বর্তমান এক নায়ক কিমের বাবা মারা যাওয়ার পর পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিল টেলিভিশনে নেতার মৃত্যুর খবর শুনে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন।
সে ছবি দেখিয়ে আমার দক্ষিন কোরীয় সহপাঠীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমরা যে বলো কিমের তার দেশে কোন জনপ্রিয়তা নেই, তাহলে এ ছবি কী প্রমান করে? জবাবে তারা আমাকে বলেছেন জানোনা বারী, এভাবে কান্না না করলে যে পরে ছবি দেখে দেখে গুলি করে মারবে!
কিন্তু মিশরে আমি প্রমান পেয়েছি মৃতের জন্যে শোক প্রকাশ করে বুক চাপড়ে কান্না করার জন্যে সে দেশে ভাড়ায় লোকও পাওয়া যায়। এই পেশার লোকজনকে বিভিন্ন হাসপাতালের ফটক বা বাজার এলাকা থেকে ভাড়া করে নেয়া হয়।
মৃতের সৎকার, সদগতি নিয়ে সেই ফেরাউনের যুগ থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর পরবর্তী নানান আয়োজনাদি মিশরের আলাদা। এদেশের অনেক লোকজন বিশ্বাস করেন মরার পর মৃতের জন্যে শোক প্রকাশের আয়োজনের ভিত্তিতে মৃতের আত্মার সদগতি নির্ভর করে।
অর্থাৎ যার জন্যে কান্নাকাটি বেশি হয় বা শোকপ্রকাশ বেশি হয় সৃষ্টিকর্তা মনে করেন এই লোকটি আসলেই ভালো ছিল। তাই এতো লোক তার জন্যে এভাবে কান্নাকাটি করছে!
কায়রোর বড় একটি অংশ জুড়ে ডেড সিটি তথা মৃতের শহর! এটিকে মোটামুটি আলাদা একটি উপশহর অথবা মৃত্যুর শহরও বলা চলে। পুরো এলাকাটি বিশাল প্রাচীরে ঘেরা।
ডেড সিটির কবর বাড়িগুলোতে থাকে অনেক গৃহহীন গরিব মানুষ। মিশর সরকার কী পর্যটকদের চোখ থেকে দেশের গরিবি লুকাতে এমন প্রাচীর দিয়ে আড়াল করেছে ডেডসিটি? হতে পারে।
হাজার হাজার বছর ধরে কায়রোর এই ডেড সিটিতে শেষ শয্যা হয়েছে অনেক ইসলামিক চিন্তাবিদ, সাহাবীর। তাদের মধ্যে হযরত জালাক উদ্দিন সিউদি, ইমাম শাফী (রাঃ), সাঈদা আইশা (রাঃ), সাঈদা নাফিসা (রাঃ), সাঈদা জয়নব (রাঃ), হযরত ওমর ইবনুল (রাঃ) এদের নাম জানা যায়।
মিশরের শেষ রাজা ফারুকের কবরও হয়েছে এই ডেডসিটিতে। ডেড সিটির মসজিদে জানাজার পরে কফিন বাইরে বের করতে ছুটে আসে ওই এলাকায় সক্রিয় পরিবহন শ্রমিকরা। ঢাকার বড় কবরস্থানগুলোতেও এমন কিছু চরিত্র আছে।
ডেড সিটির এই চরিত্রগুলো হাতে হাত লাগিয়ে কফিন ও সঙ্গী স্বজনদের তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। সবাইকে আপ্যায়ন করে শীতল পানীয়তে। সমাধি এলাকার উদ্দেশে গাড়ি রওয়ানা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের মতো এখানে মাটি খুঁড়ে কবর দেয়া দেখতে চাইলে আপনি হতাশ হবেন। এগুলো সব পাকা স্ল্যাবের তৈরি কবর। এগুলো আসলে একেকটি কবর বাড়ি। এই কবর বাড়িগুলো সাধারনত দুই কক্ষের হয়।
ধনীদের কবর বাড়িগুলোও হয় বহু কক্ষ অথবা বহুতল! এমন একটি দাফন আমি দাঁড়িয়ে দেখেছি। দাফন করতে আনা কফিনটি বাড়ির ভিতর একপাশে সরিয়ে মেঝে থেকে দুটি পাটাতন সরালেন দুই কর্মী।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি শেষে এ কক্ষটি গুহার মতো দেখতে। সেই গুহা কক্ষের মাঝখানে একটি দেয়াল। এই দেয়ালই কক্ষটিকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। একটি পুরুষদের। মেয়েদের অপরটি।
এভাবে সেই কবর বাড়িতেই একেকটি পরিবারের বংশপরষ্পরায় কবরের ব্যবস্থা হয়! এক কক্ষে হয় পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কবর। মেয়েদের কবর হয় অপর কক্ষে। পুরুষ কক্ষে ছেলে, বাবা, দাদা, এভাবে পুরো পুরুষ বংশ।
মেয়ে, স্ত্রী, মা, দাদি, শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি এভাবে পরিবারের নারী সদস্যদের বংশ পরষ্পরায় কবর পারিবারিক কবর বাড়িটির নারী কক্ষে। এভাবে শতশত বছর ধরে যে যখন মারা যাচ্ছেন তাদের শেষ শয্যা সেখানেই হচ্ছে!
বাংলাদেশি মন নিয়ে ভাবতে পারেন মাত্র দুটি কক্ষে শত শত বছ ধরে পরিবারের অত সদস্যের কবরের জায়গার ব্যবস্থা কী করে হচ্ছে? এর উত্তর শুনুন। মুখস্ত নিয়ম!
সেদিন কবর হচ্ছিলো পরিবারটির সদ্য প্রয়াত এক পুরুষ সদস্যের। তাই নতুন কফিনটি আসার পর ডেড সিটি কর্তৃপক্ষের এক প্রতিনিধি পুরুষ কবরস্থানের গুহার ভিতর ঢুকে গেলেন।
পাথরের স্ল্যাবগুলো সরিয়ে পুরনো কবর তথা কফিনের হাড়গুলো সরিয়ে নতুন কফিনের জায়গা করা হয়! গুহার ভিতর নামা ব্যক্তি চিৎকার বললেন কফিনটা দাও।
চারজনে ধরাধরি করে কফিনটি গুহায় নামিয়ে সেটিকে ধাক্কা দিলেন ভিতরে! গুহার ভিতরে থাকা ব্যক্তি কফিনে থাকা মুর্দার কেবলামুখী অবস্থান নিশ্চিত করে গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন। স্ল্যাবগুলো আবার টেনে সেগুলো ঠিকঠাক বসিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো গুহা আর সিঁড়ির মুখ। ব্যাস হয়ে গেলো নতুন একটি কবর!
মৃতের জানাজা দাফন উপলক্ষে যারা কফিনের সঙ্গে এসেছিলেন সবাই দাঁড়িয়ে দোয়া পড়লেন। এরপর যার যার মতো করে ছেড়ে চলে গেলেন করে চলে এলেন ডেড সিটি। শুধু থেকে গেলেন মৃতের একাধিক আপনজন। তারা সেই কবরবাড়িতে তিনদিন থাকবেন।
এই তিন দিন ডেড সিটির কবর বাড়িতে থেকে মৃতের জন্যে কোরান পড়বেন দোয়া করবেন। তাদের থাকার ঘর, কিচেন, বাথরূম সবকিছুই আছে সেই কবর বাড়িতে। টিভি-ইন্টারনেট সব আছে।
মিশরীয়রা বিশ্বাস করেন কবর হবার পর ওই তিনদিন মৃতের আত্মার সদগতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন! স্বজনরা ওই সময়ে কবর বাড়িতে থাকা মানে মৃতের প্রতি তারা দায়িত্বশীল।
তারা বিশ্বাস করেন কবর বাড়িতে থেকে ওই তিন দিন তারা স্বজন মৃতের জন্যে যত বেশি কোরান পড়বেন দোয়া করবেন মৃতের আত্মার জন্যে তা তত কল্যান বয়ে আনবে।
এই শোক পালন, মৃতের আত্মার সদগতি চেয়ে দোয়া-খায়েরে জন্যে সারা মিশরের ভাড়ায় লোকও পাওয়া যায়। যাদের এমন দায়িত্ব পালনের মতো নিকটজন নেই তারা তখন এমন লোকজনকে ভাড়া করেন।
ভাড়ায় আসা ব্যক্তিরা ওই তিন দিন সেখানে থেকে মৃতের ঘনিষ্ঠজনের ভূমিকা নিয়ে তারা কোরান তেলাওয়াত বুক চাপড়ে কান্নাকাটি সহ শোক-দোয়া-খায়ের করে দেবেন।
মোটামুটি একজন মৃতের জন্য কবর বাড়িতে ওই তিনদিন দোয়া দুরুদের ব্যবস্থা করা লাগবেই। আবার মৃতের জন্মদিন, মৃত্যু বার্ষিকী, রোজা, ঈদ এসব বিশেষ দিন উপলক্ষেও কবর বাড়িতে এমন দিনব্যাপী দোয়া খায়েরের ব্যবস্থা করা হয়।
এমন পেশাদার শোক-মাতম পার্টির সদস্যদের দেখা মিলে মিশরের বিভিন্ন হাসপাতালের গেটে, বাজারের কোন একটি অংশে বা মসজিদের কাছে। এরা সব সময় শোকের কালো কাপড় পড়ে থাকে।
কখন কোথা থেকে ডাক আসে, সে জন্যে তারা শোকের কালো পোশাক পরেই থাকেন। মৃতের বাড়ির সামনে, জানাজার নামাজের আগে পরে মসজিদের বাইরে তারা সুর করে এয়া লা হুই, হাবিবী আলবী, হাবিবতী আলবী এয়া আখুইয়া এসব বলে বলে নিজেদের দুই গালে, মাথায়, বুক চাপড়াতে চাপড়াতে তারা কেঁদে মরার সার্ভিস দেন।
মৃতের দাফনের পর মরাবাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত নানা আয়োজন চলে। বাড়ির সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে প্রচুর আলো ও চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব মৃতের প্রতি সমবেদনা জানাতে আসেন।
মরাবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মৃতের পরিবারের সদস্যরা অতিথিদের অভ্যর্থনা করেন। সামিয়ানার নীচে কোরান তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করা হয়। এই কোরান পড়ার জন্যে শহরের বা এলাকার বিশিষ্ট কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে রিক্রুট করা হয়।
অতিথিরা এখানে সেখানে হেঁটে হেঁটে সবার সঙ্গে শোক বিনিময় করেন। মাঝে মাঝে আল্লাহু আল্লাহু ধ্বনি দেন। অতিথিদের খাবার জন্যে সেখানে কালো কফি, সীসার ব্যবস্থা করা হয়। মহিলা অতিথিদের জন্যে রাখা হয় পৃথক ব্যবস্থা।