মক্কায় যেমন মানুষ হজ করতে যায় ঠিক তেমন সারা দুনিয়ার পর্যটকরা পিরামিড দেখতে মিশর যান। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের একটি এই মিশরের পিরামিড। আমি মিশর গেছি ফিলিস্তিন যাবার চেষ্টার ট্রানজিট যাত্রী হিসাবে।
কিন্তু আমারওতো পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের একটি মিশরের পিরামিড দেখতে ইচ্ছা করে। কায়রোর বাংলাদেশি ছাত্র শামীম-বেলাল যাদের সঙ্গে আমি থাকি, তাদের ফ্রি সময়ের ওপর নির্ভর করে আমিও নানা জায়গায় যাবার প্রোগ্রাম করি। কারন আমি যে আরবি জানিনা।
কায়রোর ডেরার আমার এসব প্রিয় প্রজন্ম বন্ধুরা প্রতিদিন আমাকে শুধু মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়াননা। ভাষা সমস্যার কারনে শামীমরা এই শহরে আমার গাইড হিসাবেও কাজ করেন।
তেমন একটি ফ্রি দিনে প্রিয় প্রজন্ম বেলাল আমার পিরামিড দেখার সঙ্গী হয়। বাংলাদেশের অবরুদ্ধ মাদ্রাসা জীবন থেকে বেরিয়ে প্রবাস জীবনের মুক্ত পৃথিবীতে আসা বেলাল আমাকে ফ্রি দেখে অনেক বন্ধু ভাবাপন্ন হন।
তাঁর দেশের এবং কায়রোর জীবনের নানাকিছু অকপটে শেয়ার করেন। এতে করে সুবিধা হয় আমারও। মিশরীয় যৌবন, তাঁর বয়সী ছেলেমেয়েদের খুনসুটি থেকে শুরু করে মনের খুঁটিনাটি নানাকিছু আমি তাঁর কাছে জানতে পারছিলাম।
কায়রোর পথেঘাটের একটি চেনা দৃশ্য বয়সী লোকজনের হাতে লম্বা সব বাহারি তসবিহ! তাদের অনেকে উঠতে বসতে এসব তসবিহ জপছেন আবার সুন্দরি মেয়েরা পাশ দিয়ে যাচ্ছে দেখলে স্বভাব দোষে সুযোগমতো তাদের উদ্দেশে তারা অশ্লীল টিপ্পনিও কাটছিলেন!
আর আমার বন্ধু বেলাল তখন বলে উঠছিলেন, দেখেন ভাই দেখেন বুড়োদের ভীমরতি দেখেন!
সারা মিশরে পিরামিড আছে ১১৮ টি থেকে ১৩৮ টির মতো। দেশটি নিয়ে একেক গবেষনা প্রকাশনায় সংখ্যাটি একেক রকম। প্রাচীন সময়ের ফারাও সভ্যতার স্মৃতি এসব পিরামিড। বলা হয় ফারাও তথা ফেরাউনরা পৃথিবীর প্রথম বিল্ডার।
প্রথম নগদ সভ্যতার স্থপতি। আর তারা এসব শহর নির্মান করেছিলেন যীশু খ্রীস্টের জন্মের, হযরত মোহাম্মদের (দঃ) জন্মেরও বহুশত বছর আগে।
প্রাচীন কালের ফারাও সভ্যতার রাজা-বাদশাহ-সম্রাটরা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে ভাবতেন বেশি। অমর হয়ে থাকার স্বপ্ন দেখতেন। সেই ভাবনা স্বপ্ন থেকেই মৃত্যুর পর তাদের লাশগুলো মমি করে রাখা হতো।
নীলনদে তখন যখন তখন বন্যা দেখা দিতো। নীলনদের বন্যায় যাতে তাদের মমিগুলো নষ্ট হয়ে না যায় সে ভাবনা থেকে তারা এসব পিরামিড তৈরি করেছিলেন। পিরামিডের ভিতরের নানা উঁচু প্রকোষ্ঠে, উঁচু পাটাতনে এসব মমি রাখা হতো।
কে কত বড় রাজা বা বাদশাহ ছিলেন সে অনুসারে নির্ধারিত হতো তাদের মমি রাখার প্রকোষ্ঠের বা পাটাতনের স্থান। অর্থাৎ তার বা তাদের মমি তত উঁচু প্রকোষ্ঠে বা নিরাপদ পাটাতনে রাখা হতো যাতে সেখানে বন্যার পানি পৌঁছুতে না পারে।
মুসলমানদের সবচেয়ে ঘৃনার ইতিহাসের ফারাও সম্রাট ছিলেন ফেরাউন। তার ইংরেজি নাম রামসিস-টু। এই রামসিস-টু তথা ফেরাউনের মমিটি কায়রোর কাছের গিজা এলাকার একটি পিরামিডের ভিতরের সর্বোচ্চ পাটাতন এলাকায় পাওয়া গিয়েছিল।
ফেরাউনের মমি এখন কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এই পিরামিড নির্মানের কাহিনী আগে লিখেছি। নীলনদের বন্যায় যাতে তাদের পূর্ব পুরুষদের মমিগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে না যায় সে কারনে সেগুলো নিরাপদ সংরক্ষিত করে রাখতে পিরামিড নামের পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের এসব স্থাপনা নির্মান করেছিল ফারাও রাজা-বাদশাহ সম্রাটরা।
কিন্তু আজ পৃথিবী বদলে গেছে। সবইতো নতুন লাগে! প্রকৃতির আজ কী খেয়াল! জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে সেই মিশরে আজ প্রায় বৃষ্টিই হয়না!
শীতে কখনও কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। এমন প্রায় বৃষ্টিবিহীন দেশ মিশরে আজ পানি সরবরাহের বিষয়টিও সাধারনের জন্যে একটি আক্রার পণ্য!
অথবা বদভ্যাসে কায়রোর রাস্তার শ্রমজীবীদের ধুলিময় বেশভূষা দেখে মনে হবে তারা গোসল করেন কম। পরিচ্ছন্নতার অভাবে দাঁতের রোগটির প্রকোপ তাদের বেশি হয়। এরজন্যে কায়রোর বিভিন্ন এলাকায় খুব বেশি দেখা ডেন্টাল ক্লিনিকের এর সাইনবোর্ড।
আবার পিরামিডের গল্পে আসি। আমার বন্ধু হয়ে ওঠা বেলালকে নিয়ে একটি ট্যাক্সিতে করে পিরামিড দেখতে আমরা কায়রোর গিজা এলাকায় যাচ্ছিলাম। অনেক দূরে থাকতে ভবনগুলোর মাথার ওপর পিরামিডের চূঁড়ো দেখে দেখে আমি রীতিমতো অভিভূত রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম।
মিশরের সবচেয়ে পুরোনো পিরামিডগুলো দেশটির সাক্কারা এলাকায় পাওয়া গিয়েছিল। খ্রীস্টের জন্মের আগে ২৬৩০-২৬১০ সালের দিকে নির্মিত প্রাচীন মাস্তাবা সম্প্রদায়ের পিরামিডেরও সন্ধান পাওয়া গেছে মিশরে।
কিন্তু সবচেয়ে উঁচু পিরামিডগুলোর অবস্থান এই কায়রোর গিজা এলাকায়। এরমধ্যে দ্য পিরামিড অব খুফু সর্ববৃহৎ উঁচু পিরামিড হিসাবে চিহ্নিত। এই খুফুকে প্রতীক ধরেই মিশরের পিরামিডকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের একটি হিসাবে ঘোষনা করা হয়েছে।
এই খুফু পিরামিডের উচ্চতা ১৪৬ দশমিক ৭ মিটার বা ৪৮১ ফুট বা ২৮০ ইজিপশিয়ান রয়েল কিউবিটস। ধারনা করা হয় এটি খ্রীস্টের জন্মের আগে ২৫৮৯ থেকে ২৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত।
মিশরের বিভিন্ন এলাকায় এমন ২০ মিটার তথা ৬৬ ফুট পিরামিড থেকে শুরু করে খুফুর ৪৮১ ফুট এমন নানা উচ্চতার পিরামিড রয়েছে।
গ্রানাইট পাথরের ব্লক, চুনা পাথরের স্লাবে স্লাবে গড়া পিরামিডের নির্মান পদ্ধতি নিয়ে পৃথিবী জুড়ে অনেক গবেষনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এর নির্মানে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ বিশেষ ধরনের চুনা পাথর।
এমন একেকটি পাথর খন্ডের ওজন আড়াই টনের বেশিও ছিল। একেকটি পিরামিড নির্মানে এমন ২৩ লাখ খন্ড পাথরও নির্মান এলাকায় নিয়ে আসতে হয়েছে!
ডেড সী সহ নীল নদ ধরে বহুদূরের পাহাড় জনপদ ধরে এসব চুনাপাথর বিস্ময়কর প্রতিভায় পরিবহন করে আনা হয়!
নানা গবেষনায় ধারনা দেয়া হয়েছে শুধু খুফার সর্বোচ্চ পিরামিডটি নির্মানে প্রায় ৪ হাজার শ্রমিককে কাজে লাগানো হয়েছে। একটি পাথর খন্ডের ওপর নিখুঁতভাবে আরেকটি পাথর বসাতে গড়ে সময় লেগেছে গড়ে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা!
পিরামিডের কর্নার এলাকার পাথর নিখুঁতভাবে বসাতে ১০ থাকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত সময়ও লাগানো হয়েছে! একেকটি পিরামিড নির্মানে দিনে এমন ৫০০ খন্ড পাথর বসাতে দিনে গড়ে কাজ করেছে ৩ হাজার শ্রমিক!
ধারনা করা হয় পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের অন্যতম কায়রোর সর্বোচ্চ গিজার খুফু পিরামিড নির্মানে ব্যয় হয়েছিল আজকের সময়ের হিসাবে প্রায় ১০২ মিলিয়ন ডলার! অনেক পিরামিড নির্মানে দাসযুগের দাস শ্রমিকদের ব্যহার করা হলেও গিজার পিরামিড নির্মানে ব্যবহৃত শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেবার প্রমান পেয়েছেন গবেষকরা।