সিঙ্গাপুর থেকে কায়রো ১৩ ঘন্টার বেশি লম্বা ফ্লাইট। মাঝে শুধু দুবাইতে রি-ফুয়েলিং এর জন্যে স্বল্প-সময়ের বিরতি। কিন্তু বিমান থেকে কারও নামার সুযোগ ছিলোনা। কায়রোর বাংলাদেশ দূতাবাস আমাকে মর্যাদার সঙ্গে অভ্যর্থনা করলো বিমান বন্দরে। আমার জন্যে তারা একটি হোটেলও ঠিক করে রেখেছিল। বললো ভাড়া বেশি নয় ভাই। মাত্র দেড়শ ডলার।
আমি তাদের ধন্যবাদ দেই। মনে মনে বলি তোমরা জানোনা আমি কত দরিদ্র কিসিমের রিপোর্টার। অত টাকার রূমে সহজে থাকিনা। রিপোর্ট করতে গিয়ে আরিচাঘাটের কুড়ি টাকার রূমেও থেকেছি কতোদিন! দৈনিকবাংলা মোড়ের পত্রিকার গাড়িতে চড়ে গিয়ে দেশের কত প্রান্তে গিয়ে রিপোর্ট করেছি।
হোটেলে থিতু হতেই দূতাবাসের এক কর্মকর্তাকে বললাম আমি এখানকার বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তেমন দু’জন হোটেল কক্ষে চলেও আসে। শামীম আর বেলাল। চট্টগ্রামে বাড়ি। দেশে থাকতে মাদ্রাসায় মাদ্রাসা পড়তেন। আহলে সুন্নত আল জামায়াতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নতুন একটি জগতের সন্ধান পাই। বাংলাদেশ-মিশরের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের ছাত্রদের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। ১৯৯৭ সালে সেই বৃত্তির পরিমান ছিল মাসে পয়ষট্টি ইজিপশিয়ান পাউন্ড।
যেহেতু পড়াশুনার মাধ্যম আরবি তাই বাংলাদেশের মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রছাত্রীদেরও এর সুযোগ নেয়া সহজ। কিন্তু আমাকে বলা হয় বাংলাদেশের খুব মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী এই বৃত্তির খবর জানেন!
তখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের দেড়শ ছাত্র আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে। ফিলিপাইনের মরো মুসলিমদের ছিল আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী। মালয়েশিয়ার ছাত্রছাত্রী ছিল দশ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশের ছাত্র ছিল একশ’র কম।
শার্ট-প্যান্ট পরেছিলেন শামীম-বেলাল। দু’জনেই ক্লিন সেভড। বললেন বাংলাদেশে কোনদিন শার্ট-প্যান্ট পরেননি। মাদ্রাসার ছাত্র শার্ট-প্যান্ট পরা নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। লজ্জাও করতো। মিশর যাবার পর আর লজ্জা করেনি।
বললেন, ইসলাম যে কত আধুনিক ধর্ম তা মিশর না এলে জানা হতোনা। ধর্মীয় দিকতো বটেই, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যা নিয়ে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা হয়না।
মিশর গিয়ে তাদের জীবন-বেশভূষাও বদলে গেছে। বাংলাদেশে তাদের দাঁড়ি ছিল। ওই সময় মিশরে মুসলিম ব্রাদার হুড জঙ্গি সংগঠন হিসাবে ছিল নিষিদ্ধ। ব্রাদারহুডের সদস্যরা দাঁড়ি রাখতো বলে তখন জঙ্গি জ্ঞানে দাঁড়ি রাখার সামাজিক বিপদও ছিল সেই সমাজে।
যুক্তি হিসাবে দেখাতে গিয়ে বলা হলো মিশরের প্রধান ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড মুফতিরও দাঁড়ি নেই। একনায়ক হোসনী মোবারকের শাসন তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট। তবে তাঁর মন্ত্রিসভায় ছিল কুড়িজনের বেশি ডক্টরেট ডিগ্রীধারী। দেশের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসতেন হোসনী মোবারক।
সে দেশটায় গ্র্যান্ড মুফতির দেয়া ফতোয়া আইন হিসাবে গ্রহন করা হতো। অথবা সুবিধামতো ফতোয়া দেয়ানো হতো গ্রান্ড মুফতিকে দিয়ে! যেমন তখন মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি একটি ফতোয়া দেন ব্যাংকের সুদ হালাল।
এরজন্যে গ্র্যান্ড মুফতি একটি ব্যাখ্যাও দেন। তাঁর ব্যাখ্যাটি হলো, ইসলামের ইতিহাসে যখন সুদ হারাম ঘোষনা করা হয় মানুষ ক্ষুধার জন্যে ঋন করতো। এর সুদ পরিশোধ করাটা তাদের জন্যে জুলুম হতো। এখন ব্যাংক গ্রাহকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে।
এর লভ্যাংশ সুদ আকারে গ্রাহককে দেয়। বুদ্ধিমান গ্র্যান্ড মুফতি হয়তো বুঝেছিলেন তার ফতোয়া নিয়ে মুসলিম বিশ্বে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর একটি ব্র্যাকেট দিয়ে বলেন তার ফতোয়া শুধু মিসরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সে জন্যে তাঁর ফতোয়াটি মিশরের বাইরে আসেনি।
এখন এই শামীম-বেলালকে যে কারনে হোটেলে ডেকে এনেছি তা বলি। তাদেরকে বললাম আমি বেশ কিছুদিন মিশরে থাকবো। এত টাকার রূমে আমি থাকতে পারবোনা। আমি সস্তার একটি একোমডেশন চাই।
ঠিক হয়ে গেলো আমি শামীমদের সঙ্গেই থাকবো খাবো। এরজন্যে প্রতিদিন তাদেরকে দেবো পঁচিশ পাউন্ড। টাকার প্রস্তাবটা শামীমেরই ছিল। আমি তাতেই রাজি। হোটেলের সেদিনের পেমেন্ট দিয়ে আমি তাদের সঙ্গেও চলে এলাম নতুন ডেরায়।
শামীমদের সঙ্গে আসায় আমার অনেকগুলো সুবিধা হলো। প্রথমত আমি আরবি বুঝিনা। তাই নানা জায়গায় যেতে তাদের সহায়তা নিচ্ছিলাম। অনেক ক্ষেত্রে তারা দোভাষী হিসাবেও সাপোর্ট দিচ্ছিল। আর তাদের সঙ্গে থাকায় ভাত-মাংস খাবার সুযোগ! আহা!
আবার যখন শামীমরা আমার সঙ্গে থাকতে পারতোনা তখন টেক্সি চালকদের ম্যানেজ করতে কিছু আরবি শব্দও তাদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলাম। যেমন আলাতুল মানে সোজা। ইয়েমিন মানে বায়ে। সীমাল মানে ডানে। শুকরান-ধন্যবাদ। হাবিবি-বন্ধু। খালাস-শেষ।
কায়রোর তাকি কোম্পানির কারখানার পাশে শামীমদের বাসা। টেক্সিওয়ালাকে বলতাম-আমামা তাকি। মানে তাকি কারখানার পাশে। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের কাছে এক দোকানে রিপোর্ট ফ্যাক্স করতে যেতাম। টেক্সিওয়ালাকে বলতাম হাদিকাতুদ দৌলিয়া। মানে আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস।
টেক্সি ড্রাইভার যারা মোটামুটি ইংরেজি জানতো তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতাম। কিন্তু এদের বেশিরভাগ বাংলাদেশ কোথায় তা প্রথমে বলতো জানেনা। গাম্বল হিন্দ তথা ভারতের পাশে বললে চিনতো। এরপর বলতো বাঙালাদেশ বাঙালাদেশ।
কেউ কেউ বলতো সে সৌদি আরবে থাকতো অনেক বাঙালাদেশের মানুষ দেখেছে। তারা খুব গরিব। তাই অল্প মজুরিতে কাজ করে। মনে মনে বলি আরবরা বলে মিশরের লোকজন তথা মাশরিরা গরিব।
আর তুমি বলছো বাংলাদেশের লোক গরিব! কেনো কম টাকা কাজ করে তাতো জানি বুঝি। আরবি জানেনা। যে যখন আরবি ভাষাটা ভালো করে শিখে ফেলে তখন ভালো বেতনের কাজই করে।
তখন কায়রোর সিনেমা হলগুলোয় মুম্বাইর ছবি মুক্তি পেতো। মিঠুন চক্রবর্তীর ডিসকো ড্যান্সার ছবিটা সুপার ডুপার হিট করেছিল। তাই পথেঘাটে অনেকে আমাকে ভারতীয় মনে করে থামিয়ে ‘আই এ্যাম এ্যা ডিসকো ড্যান্সার’ গানটি গাইতে গাইতে জুড়ে দিতো নাচ। তাদের খুশি করতে আমাকেও কখনো কখনো তাদের সঙ্গে নাচতে হয়েছে।