মানব জাতির বিকাশের পর থেকে তার কিছু চিন্তা ও তদ্রুপ কর্ম বর্তমান সময় পর্যন্ত চলে আসছে। তন্মধ্যে নব আবিস্কার যেমনি, তেমনি তার কর্মের সফলতার স্বিকৃতী আর তার মধ্যে প্রোথিত আত্মবোধ এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রবনতা অন্যতম। মানুষের যদিও বিবেক দ্বারা তাড়িত হওয়া শ্রেয়, তথাপিও সে তার নানাবিধ ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন একই সমস্যায় যদি দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ পতিত হয়, সেক্ষেত্রে সাহায্যকারী পুরুষ হলে সে তার বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে আর সমলিঙ্গের জন কে এড়িয়ে যাবে। আমরা সাধারণত রাস্তায় বের হয়ে রিক্সা ভাড়া করতে চাইলে দেখি চালক পুরুষ যাত্রীর চাইতে নারীকে যাত্রী হিসেবে প্রাধান্য দেয়, তেমনি হাসপাতালের নার্সরাও তাদের বিপরীত লিঙ্গের রোগীর প্রতি বেশি মনযোগী হয়।
একজন সাধারণ ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল পর্যন্ত সবাই তাদের অপকর্মকে বৈধতা বা সঠিকরুপে স্বীকৃতি দিতে চেষ্টা করে। চোর হয়ত বলে, বাঁচার তাগিদে সকল কিছুই বৈধ, কিন্তু পুকুর চোরেরাও কম যায়না। তারা তাদের কৃত অপকর্মের ফলকে ভালো কাজ করার সুবাদে সামান্য উপহার কিংবা স্পিডমানি হিসেবে চিহ্নিত করবে। ছোট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকলেই তার কর্মের জন্য প্রশংসিত হতে চায়, হোক সেটা ভালো কিবা মন্দ।
আর আত্মবোধ এর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারটা আমাদের প্রিয় স্বদেশেেে প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি তবে আমরা দু ধরনের আত্মবোধ পাই, একটি ব্যাক্তি পর্যায়ের আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের আত্মবোধ। আর দুটোকেই আমরা শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে পড়ি।
আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি শত সহস্র পেশাজীবি মানুষের কর্মের দ্বারা চালিত। অতি সাধারণ চা বিক্রেতা থেকে শুরু করে কামার কুমার জেলে কৃষক মেথর অথবা ইট পাথরে তৈরি সুরক্ষিত অট্টালিকায় বসে চাকুরীরত লোকজন, ব্যবসায়ী তথা গার্মেন্টস কর্মী, সকলের দানে সকলের ভালোবাসায় এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই প্রিয় স্বদেশ। কিন্তু সাধারণ কৃষকটিও যখন কিছু পরিমাণ ভুমির মালিক বনে যান কিবা কোন জেলেও কিছুদিন অধিক পরিমাণে মাছ আহরণ করেন তখন সে ভুলে যায় তার সমগোত্রীয় সহযাত্রীদের কথা। সে তার শ্রেষ্ঠত্বের তারীফ করা শুরু করে।
তেমনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন পেশাজীবির প্রান্তিক মানুষের সন্তানরা বিভিন্ন বিদ্যাপিঠে লেখাপড়া করে যার প্রত্যেকটি সরকারি খরচে পরিচালিত, যাহা প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষের টাকায় পরিচালিত। নিশ্চিতভাবেই তারা সুশিক্ষিত হয়ে দেশসেবার কাজে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। শুরু হয় প্রতিযোগিতা, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা। প্রথমত নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অতঃপর প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেষ্ঠত্ব। ব্যাক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা হতে থাকে নিজ বনাম পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে। সেখানে একেকজন একেক মানদণ্ড ঠিক করে। যে সুদর্শন, সে সৌন্দর্যকে শ্রেষ্ঠত্ব ভাবে। যে নামকরা প্রতিষ্ঠানেে সেরা বিষয়ে লেখাপড়া করে, সে সেটাকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড করে। আবার কেউ তার পেশাগত পদবীর অবস্থানকে মানদণ্ড মনে করে। কিন্তু কেউই নিজ ব্যাতীত অন্যকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভাবেও না, স্বীকার ও করেনা। আমরা ভুলে যাই, কাউকে সেরা বলা মানে এই নয় যে নিজের যোগ্যতা কমে যাওয়া। এটা তার বিনয়ের প্রকাশ যা তার মহত্বকে আরো বৃদ্ধি করে।
অন্যটি হল প্রাতিষ্ঠানিক বা গোষ্ঠীগত আত্মবোধের শ্রেষ্ঠতা। আমরা আমাদের পেশাগত প্রতিষ্ঠান বা কোন গোষ্ঠীর আওতায় বিকশিত হই। আজকের এই বিশ্বায়নের যুগেও আমরা আমাদের পেশাগত প্রতিষ্ঠান বা কমিউনিটিকে এমনভাবে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করি এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে ব্যতিব্যাস্ত থাকি, যেন দেশে সেবামুলক বা দায়িত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠান একটিই আছে। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্যের দাবী করেই ক্ষান্ত হই না বরং অন্য কোন কোন্ প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি ক্ষমতাশালী বা সব প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী তা প্রমান করতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীকে আক্রমনাত্মক কথা বলতেও কুন্ঠাবোধ করি না।
আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবেনা যে, এই মাটির প্রতি আমাদের যেমন দায়বদ্ধতা আছে, এর ভুমিপুত্রের প্রতিও তেমনি দায়বদ্ধতা আছে। ছোট্ট এই দেশে সকলেই ভাতৃপ্রতিম ও আত্মার আত্মীয়। আমরা সকলেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। আর এই দেশকে তার কাঙ্খিত অবস্থানেে পৌছাতে হলে আমাদেরকে সকল সংকীর্ণতা ত্যাগ করে হাতে হাত ধরে মানববন্ধন তৈরি করে এগিয়ে যেতে হবে। সর্বোপরি মানুষ হিশেবে আমরা যদি মহান হতে চাই, তবে নিজের বা নিজ প্রতিষ্ঠান কিবা নিজ গোষ্ঠীর বড়ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে সকলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও ভাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই আমাদের মানব জনম সার্থক হবে।