(বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক কিংবদন্তী, ক্ষণজন্মা পুরুষ নাজিম উদ্দিন মোস্তানের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী ১৮ আগষ্ট। ২০১৩ সালের ১৮ আগষ্ট তিনি মারা যান। সাংবাদিকতা ছিল তাঁর কাছে ইবাদত-দেশসেবার অংশ।
তিনি বাংলাদেশের সৎ সাংবাদিকতার মডেল। আজকের যুগের চোর-চোট্টাদের মতো সাংবাদিকতাকে তিনি টাকা বানানোর মেশিন হিসাবে দেখেননি। মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান সাংবাদিকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী)
সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তানকে আমি প্রথম দেখি ১৯৮৭ সালে। আমি তখন একজন পর্যটক।সারাদেশ ১৮ মাসে পায়ে হেঁটে ঘুরে ঢাকায় এসেছি। আমার এক বন্ধু একদিন আমাকে ইত্তেফাক অফিসে নিয়ে গেলেন।
তাঁর ইচ্ছা ছিল ইত্তেফাকে আমাকে নিয়ে একটা রিপোর্ট হোক। ইত্তেফাক ভবনের রিপোর্টিং’এ হালকা পাতলা একজন লোককে খুবই ব্যস্ত দেখি। রিপোর্টারদের নানা রিপোর্টের তাগিদ দিচ্ছেন। পরে জানতে পারি তিনি নাজিম উদ্দিন মোস্তান।
ইত্তেফাকের চীফ রিপোর্টার। আমার বন্ধু আমাকে দেখিয়ে তাঁকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই তিনি একজন রিপোর্টারকে ডেকে তাঁর টেবিলের সামনে আমাদের বসিয়ে দিলেন। সেই রিপোর্ট ইত্তেফাকে ছাপা হয়নি। হয়তো সেই সাংবাদিক তা লিখেনইনি।
আমিও এরপর বিচিন্তায় সুযোগ পেয়ে বিচিন্তার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। পরে রিপোর্টের কাজে ঢাকার নানা স্পটে গিয়ে তাঁকে দেখতাম। খেয়াল করে দেখতাম তিনি কিভাবে নোট নেন। কিভাবে একজনকে প্রশ্ন করেন। খুব দ্রুত তিনি নোট নিতে পারতেন।
একটু তাঁকে নিয়ে বলে নেই আরও কিছু তথ্যঃ নাজিম উদ্দিন মোস্তানের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার সকদি গ্রামে। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম হয়। বাবার নাম হাফিজউদ্দিন এবং মায়ের নাম সায়েরা খাতুন।
সকদি গ্রামে পড়াশোনা শুরু করে চাঁদপুর চান্দ্রা হাইস্কুল থেকে এসএসসি প্রথম বিভাগে পাস করেন। চট্টগ্রাম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৬৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে।
চট্টগ্রামের দৈনিক সমাচার পত্রিকায় প্রুফ রিডারের চাকরি দিয়ে শুরু হয় তাঁর পেশা জীবন। ঢাকায় এসেও বাংলাবাজারের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে প্রুফ রিডারের চাকরি নেন। সংগ্রামী মানুষের গল্পের মতো একটা জীবন তাঁর তাইনা?
সাংবাদিকতায় তাঁর প্রথম পত্রিকার নাম পয়গাম। তাও রিপোর্টার হিসাবে নয়। এ পত্রিকায় তিনি সহ সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে কাজ শুরু করেন দৈনিক ইত্তেফাকে। এ পত্রিকায়ও প্রুফ রিডার হিসাবে যোগ দেন।
এরপর এর সহ সম্পাদক, চীফ রিপোর্টার পর্যন্ত হয়েছেন। ইত্তেফাকে যোগ দেবার আগে তিনি কাজ করেছেন মাওলানা ভাসানীর হক কথা’ পত্রিকায়। নিরন্তর কাজের ফাঁকে তিনি দুটো বিষয়ে মাস্টার্সও করেছেন।
ইত্তেফাকে চীফ রিপোর্টার হওয়ার পর রিপোর্টাররা তাঁর বিরুদ্ধে কলম বিরতিও চালিয়েছিলেন। এর কারণ ছিল তাঁর স্বচ্ছতা এবং আপসহীনতা। এরপর থেকে পেশাজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকে।
সহজ ভাষায় বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে লেখালেখির জন্য ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স আইডিই নাজিম উদ্দিন মোস্তানকে সম্মানিত করে।
প্রযুক্তিবিষয়ক পত্রিকা কারিগর সাংবাদিকতায় অবদান রাখায় পদক প্রদান করে ১৯৯০ সালে। তাঁকে পুরস্কৃত করে সমাজ কল্যাণ সংঘ। নাজিম উদ্দিন মোস্তান রোটারি ক্লাব অব রমনার পদকও পান।
সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০০৩ সালে তাঁকে একুশে পদক দেয়া হয়। একই বছর বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ও বিসিএস কম্পিউটার সিটি তাকে আজীবন সম্মাননা জানায়।
আবার তাঁর সঙ্গে আমার কথায়ঃ একদিন আমাকে নিয়ে ইত্তেফাকে আড্ডা দিতে যান আমাদের বন্ধু নুরূল ইসলাম ছোটন। তখন তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি করতেন। আমরা তাঁকে ছোটন ভাই বলে ডাকতাম। মিডিয়ার লোকজন সহ অনেকেই তাঁকে চিনতেন জানতেন।
ঢাকায় সাংবাদিকতার শুরুর দিনগুলোতে রাজনৈতিক সোর্স গঠনে এই ছোটন ভাই আমাকে বিস্তর সহযোগিতা দেন। ইত্তেফাকে আড্ডার নামে তিনিও আমাকে নিয়ে গেলেন এই নাজিম উদ্দিন মোস্তানের কাছে।
আমরা তাঁর টেবিলের সামনে দু’টো চেয়ার টেনে বসি। ছোটন ভাই আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই হাতের কাজ থেকে চোখটা তুলে তাকিয়ে বলেন, ‘নামটা বড় পরিচিত মনে হচ্ছে। বিচিন্তার ফজলুল বারীতো’।
তখন ইনকিলাবে আরেকজন ফজলুল বারী ছিলেন। নারায়নগঞ্জে বাড়ি। ইত্তেফাকের চীফ রিপোর্টার আমাকে বিচিন্তার ফজলুল বারী হিসাবে চিহ্নিত করে বললেন, ‘আমি আপনার লেখা আমি পড়ি, আপনি ভালো লিখেন’।
আমি তাঁর কথায় তখন যুগপৎ আলোড়িত বিস্মিত হই! প্রশংসা কার না ভালো লাগে। সেই থেকে তিনি আমারও মোস্তান ভাই। ইত্তেফাকের দিকে গেলে ঢু মেরে দেখি তিনি আছেন কিনা। তিনি থাকলে গিয়ে বসে পড়ি তাঁর টেবিলের সামনে।
তিনি আমাকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে কুশল জানতে চাইতেন। এতে মাঝে মাঝে বিব্রত-লজ্জাও লাগতো। ইত্তেফাকে মোস্তান ভাইর সামনে গিয়ে বসলে তিনি প্রায় আমাকে এটা খাওয়ান সেটা খাওয়ান।
ইত্তেফাকের কেন্টিনের পরোটা-গরুর মাংস বা ভুনা খিচুড়ি তখন অনেকবার তাঁর সৌজন্যে খেয়েছি। এরসঙ্গে থাকত কোন একটা ড্রিঙ্কস। একদিন আমার জন্যে কোকের বোতল আনতে বললেন। আমি জানতে চাইলাম, আপনি খাবেননা?
মোস্তান ভাই যে জবাব দিলেন তা শুনে আমি হাসতেই থাকি। আমাকে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি বোতল খাইনা’। পরে জেনেছি নীতিগত কারনে তিনি কোন বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানির কোন পণ্য খেতেননা বা ব্যবহার করেননা।
তখন কোকাকোলা শুধু বোতলেই বিক্রি হতো। আজকের সময়ের মতো কোকাকোলা’র ক্যান বা প্লাস্টিকের বোতল তখন ছিলনা। আমি আমার বন্ধুদের কাছে সুযোগ পেলেই মোস্তান ভাইর নানা গল্প করতাম।
সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তানের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ-সম্পর্ক আছে, এটাও ছিল তখন আমাদের প্রজন্মের গৌরবের একটি অংশ। তখন তাঁর এই ‘আমি বোতল খাইনা’ এই সংলাপটি বললে তারাও মজা পেতেন।
আমার কাছে গল্প শুনে অনেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তিনি তাদের সমান সমাদর করতেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষের দিকে সুযোগ পেলেই মোস্তান ভাই’র সঙ্গে সচিবালয়ে যেতাম। মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্য।
নাজিম উদ্দিন মোস্তান এসেছেন শুনলে তারা তাঁকে ডাকতে বেশি দেরি করতেননা। মোস্তান ভাই এমন অনেকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলে তাদের অনেকে পরে আমারও সোর্স হয়ে যান। রিপোর্টারতো সোর্সের সাগরে ভাসে।
যার যত সোর্স সে তত ভালো রিপোর্ট করতে পারে। তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষনা দেন। ওই দিন দুপুর বেলা কার্ফুর ভিতর মোস্তান ভাই’র সঙ্গে সচিবালয়ে কাজী জাফরের রুমে যাই।
কাজী জাফর তখন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের সামনে তখনও তিনি কাব্য করছিলেন। কাজী জাফর বলছিলেন তিনি রাজপথের গন্ধ টের পান। এই আন্দোলন কোন গণআন্দোলন নয়। মেঘের এই সাময়িক আঁধার কেটে যাবে।
প্রকৃতির নিয়মে আবার আকাশে সূর্য হাসবে’। কাজী জাফরের কথাগুলো তখন আর লেখার সুযোগ পাইনি। কারন সে রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষনা দেবার পর তাঁর সব লোকজন যেভাবে পালিয়ে যান, কাজী জাফরও সেভাবে সপরিবারে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এরশাদের পতনের পরও মাঠে ঘাটে নানা জায়গায় মোস্তান ভাইর সঙ্গে দেখা হতো। হাতে তাঁর কাগজের বান্ডিল। কোন পত্রিকা অথবা কোন একটি বই। আর নিউজপ্রিন্টের প্যাড। খুব দ্রুত হাঁটতেন তিনি। মনে হতো যেন দৌড়াচ্ছেন!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের কাছে তাঁর কিছু গল্প শুনে চমকে গিয়েছিলাম। আমাকে তারা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে এমন কিছু বই পড়ানো হয় সেগুলো নাজিম উদ্দিন মোস্তানের লেখা!
সেগুলো বিভিন্ন অধ্যাপকের নামে চালু পরিচিত থাকলেও আসলে সেগুলো লিখেছেন নাজিম উদ্দিন মোস্তান! এটা কীভাবে সম্ভব? আমাকে তারা বলেন এক সময় ঘনিষ্ঠ শিক্ষকরা একই বিষয়ের কয়েকটি বই তাঁকে ধরিয়ে দিতেন।
মোস্তান ভাই সেগুলো পড়ে তৈরি করতেন নতুন একটি পান্ডুলিপি। অতঃপর সেই বই সেই অধ্যাপকের নামে মুদ্রিত হয়ে বাজারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেনীকক্ষে চলে যেত। ঢাকার প্রথম দিনগুলোয় অনেক অর্থকষ্টে থাকতেন নাজিম উদ্দিন মোস্তান।
তাঁর সেই অর্থ কষ্টের দিনগুলোয় সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান এভাবে পরের জন্যে পান্ডুলিপি লিখে হয়তো কিছু টাকা পেয়েছেন। কিন্তু নিরেট লাভ যেটা হয়েছে তাহলো ওই পুরো বিষয়টি তাঁর মুখস্ত-আত্মস্থ হয়ে গেছে।
এরজন্যে এত গভীরতা থাকতো নাজিম উদ্দিন মোস্তানের রিপোর্টে। যে কোন বিষয়ে মুন্সিয়ানা ফুটে উঠতো তাঁর লেখায়। এতে মুগ্ধ বুদ্ধিজীবী আহমেদ ছফা বলতেন, নাজিম উদ্দিন মোস্তানের লেখা যে কোন রিপোর্টই পুরস্কার পাবার যোগ্য।
আর নাজিম উদ্দিন মোস্তানের রিপোর্টের গভীরতা কেন বেশি তা বোঝাতে তাঁর বই বিষয়ক তথ্যটি আমাকে বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষক। আমি একবার এ ব্যাপারে মোস্তান ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। লাজুক হেসে এড়িয়ে গেছেন।
এরশাদের পতনের পর নিষিদ্ধ বিচিন্তা আবার বেরোয়। বাজারে আসে নতুন অনেকগুলো সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রথম দফা বিচিন্তার সহকর্মীরা বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তারা আর পিছনে ফিরে আসেননি।
আমি বিচিন্তায় ফিরে এলে আমার অনুরোধে আমাদের কাগজেও লিখতে শুরু করেন মোস্তান ভাই। লেখা আনতে যেতাম ইত্তেফাক অফিসে বা তাঁর শুক্রাবাদের ভাড়া বাসায়। যখনই গেছি দেখি মোস্তান ভাই লিখছেন!
তখন অনেকগুলো কাগজে লিখতেন মোস্তান ভাই। বিচিন্তায় একটা লেখার জন্যে তাঁকে কত দেয়া হতো? সম্ভবত তিনশ, অথবা পাঁচশ টাকা। কিন্তু আমি তখন দেখেছি অনেকে দিনের পর দিন মোস্তান ভাইর কাছ থেকে লেখা নিচ্ছে কিন্তু টাকা দিচ্ছেনা!
টাকার ব্যাপারে মোস্তান ভাই ছিলেন বরাবর লাজুক প্রকৃতির। কেউ টাকা না দিলেও তিনি কখনও মুখ ফুটে চাইতেননা। বা চাইতে পারতেন না। মোস্তান ভাইকে চাপাচাপি করলে বলতেন, ওরা হয়তো পারছেনা তাই দিচ্ছেনা।
শুক্রাবাদের সেই বাসাটা ছিল খুব সাদামাটা। তখনও ঢাকার অনেক ভুঁইফোড় সাংবাদিক থাকতেন অট্টালিকায়। আর আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিশ্রমী সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান থাকতেন শুক্রাবাদের সাধারন মানের ভাড়া বাসায়।
অথচ তাঁর যে নাম-ডাক, তাঁর বাসা-জীবন দেখলে খারাপ লাগতো। আবার শ্রদ্ধাও লাগতো। শ্রদ্ধা বাড়তো। কারন আমি দেশের একজন সৎ সাংবাদিকের জীবন দেখতাম। তিনি তাঁর মতো একজনই। তিনি নাজিম উদ্দিন মোস্তান।
বিচিন্তার কর্মীদের প্রায় সবাই তখন আমরা অফিসে থাকতাম। অফিসেই বাজার-রান্না-খাওয়া চলতো। তখন প্রায় আমাদের ভালো খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন মোস্তান ভাই। এরজন্যে মিসেস মোস্তান তথা আমাদের ভাবীর ওপর চাপ পড়তো।
আমাদের পুরো টিমের প্রায় দাওয়াত থাকতো মোস্তান ভাইর শুক্রাবাদের বাসায়। আইটেম থাকতো কুড়ি-পঁচিশ বা এরও বেশি! প্রাধান্য থাকতো নানা রকম ভাজি ভর্তার। নানান ছোট মাছের অনেক আনকমন আইটেমও থাকত।
শুক্রাবাদের ছোট বাসায় আমাদের এত লোকের জায়গা হতোনা। এখানে সেখানে যে যেখানে পারতাম বসে পড়তাম। আমাদের দলের যারা সঙ্গে আসতে পারেনি তাঁদের খাবার প্যাকেট করে দিতেন ভাবী। এসব মনে করতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে।
ইত্তেফাকে তিনি অনেক স্মরণীয় রিপোর্ট করেছেন। প্রযুক্তি বিষয়ক রিপোর্ট, তরুনদের সম্ভাবনা নিয়ে রিপোর্টের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। তাঁর সময়ের লোকজন যেখানে প্রযুক্তি বিমুখ তিনি ছিলেন সম্পূর্ন ভিন্ন। প্রযুক্তিবান্ধব।
বাংলাদেশ নামের দেশটা নিয়ে কোন হতাশা তাঁর মধ্যে কাজ করতোনা। যে আলোচনা যখন করতাম তিনি সেটিকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতেন। দেশের মানুষের সততা পরিশ্রম আর উদ্ধাবনীর শক্তির গল্প করতে গিয়ে নাজিম উদ্দিন মোস্তানের চোখ মুখ কথা বলতো।
মোস্তান ভাইর শেষ বিপ্লবটার নাম ছিল রাষ্ট্র নামের একটা পত্রিকা। এই পত্রিকার প্রায় পুরোটাই তিনি নিজে লিখতেন। যেখানে থাকতো দেশের নানা সম্ভাবনা উদ্ধাবনের উজ্জ্বল বয়ান।
দেশ নিয়ে ভবিষ্যতের তরুনদের নিয়ে তাঁর স্বপ্নধারায় সমৃদ্ধ থাকতো ছোট টেবলয়েট সাইজের রাষ্ট্র’ নামের কাগজটায়। এই পত্রিকার কপি তাঁর সঙ্গে থাকত। দেখা হলেই ধরিয়ে দিতেন। আমি মাঝে মাঝে পত্রিকাটির দাম দিতে চেষ্টা করতাম।
তিনি নিতেননা। রাষ্ট্র যেদিন বন্ধ হয়ে গেল মূলত সেদিনই মৃত্যু হয় এর স্বপ্নদ্রষ্টার। স্বপ্ন হারিয়ে গেলে স্বাপ্নিক বাঁচেনা। তাঁর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর আমার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। এটা যেন এক রকম নির্ধারিত ছিল।
কারন তিনি শুধু কাজ করতেন।শরীর নামের যন্ত্রের কোন যত্ম তিনি নিতেননা। উল্টো রীতিমত অত্যাচার করতেন। যন্ত্রটি তাই বিগড়ে গিয়েছিল। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরনের প্রতিক্রিয়ায় শেষ দিনগুলো তাঁর শারীরিক পঙ্গুত্বে কষ্টে কেটেছে।
কষ্টটা গেছে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ওপরও। এমন একজন নাজিম উদ্দিন মোস্তানের জন্যে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইত্তেফাক যা করেছে তা অতুলনীয়। বাংলাদেশের মিডিয়ায় এমন নজির খুব বেশি নেই।
ইত্তেফাক সেদিন তাঁর পাশে না দাঁড়ালে তাঁর পরিবারটি তখনই পথে বসে যেত। আমি আমার অনুজ সাংবাদিকদের সব সময় মানুষের সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তানের গল্প বলি।
সাংবাদিকতায় ভালো করতে খুব একটা মেধাবী আর সুন্দর চেহারা সুরতের দরকার নেই। দরকার একজন নাজিম উদ্দিন মোস্তানের মতো পড়াশুনা আর পরিশ্রমের। সততার। এসব আমি আমাদের মোস্তান ভাইর কাছে শিখেছি।
নতুন সাংবাদিকরা ইত্তেফাকের লাইব্রেরি বা আর্কাইভে গিয়ে মোস্তান ভাইর রিপোর্টগুলো, রাষ্ট্রের সংখ্যাগুলো পড়ার চেষ্টা করলে উপকৃত হবেন। সাংবাদিকতায় উপরে ওঠার কাঠামো মোস্তান ভাইর রিপোর্টের ভিতরেই।
বাংলাদেশের জন্যে সব সময় কয়েকজন নাজিম উদ্দিন মোস্তান দরকার। ভালো থাকবেন প্রিয় মোস্তান ভাই। বড় ভালো ছিলেন আপনি। একজন সৎ মানুষ সাংবাদিক ছিলেন। আজকের বাংলাদেশে এর বড় অভাব।
আসুন আমরা আমাদের প্রিয় মানুষটির জন্যে একটু কাঁদি নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায়ঃ
অনন্তকালের তরে/গৌড়মন মধু করে/পান করি, করিবেক/যশস্বী তোমারে।