আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনেতো ফেসবুক, মোবাইল ফোন সহ আজকের নানাকিছু ছিলোনা। তখন আমরা বই পত্রপত্রিকা পড়তাম। আমরা পত্র মিতালি করতাম। চিঠি লিখতাম একজন আরেকজনকে।
বিভিন্ন পত্রিকায় পত্র মিতালির আলাদা বিভাগ ছিল। আলাদা পত্রিকাও ছিল পত্র মিতালির। পত্রিকার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকেও আমরা নতুন একজন বন্ধু খুঁজে নিতাম। ছেলেরা মেয়ে নাম নিয়েও পত্র মিতালি করতো।
আমরা একটা ছদ্মনাম ছিল সুরমা বদরুল। সিলেটের নদীর নাম সুরমা। পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে অনেক চিঠি ছাপা হতো এই সুরমা বদরুলের নামেও! অনেকে সুরমা বদরুলকে মেয়ে মনে করে চিঠি-কবিতা লিখে পাঠাতেন।
ডাকযোগে উপহারও আসতো! আবার আমরা যারা বিভিন্ন পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে লিখতাম তাদের মধ্যেও কখনও দেখা হলেও পত্র মিতালি গড়ে উঠতো। আমার তেমন একজন পত্রমিতা ছিলেন ওবায়দূল্লাহ মৃধা।
মাতুয়াইলের মৃধা বাড়িতে বাড়ি। তাদের পরিবারের নামেই ওই জায়গাটার নাম মৃধা বাড়ি হয়েছে। তা ওবায়দুল্লাহ সৌদি আরব যাবে সোনার হরিনের খোঁজে। আরব দেশে টাকা খনি রিয়াল মাখা বালি!
ওই আমলে এমন কারও বিদেশ যাওয়া মানে বিশাল কিছু। আমার বন্ধু চলে যাবে বিদেশে। তাঁকে বিদায় জানাতে সিলেট থেকে আমি চলে এলাম মাতুয়াইলের মৃধা বাড়িতে। বাড়ি সামনে শান বাঁধানো ঘাটওয়ালা বড় পুকুর, মসজিদ।
সেই পুকুরে নেমে সাঁতরে অনেক গোসলও করেছি। আমাকে তখন তাদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখায় ওবায়দুল্লাহ। শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামালের বাড়ি ওই মাতুয়াইল গ্রামে। তখন পুরনো পাকা সাদামাটা বাড়িটাকে বড় মলিন মনে হতো।
কারন সুলতানার ছোট বোনের সঙ্গে বিয়ে হয় শেখ জামালের। শুধুমাত্র এই অপরাধে হাতের মেহেদির রঙ থাকতেই দূঃখিনী দুই বোনকে ১৯৭৫ সালের পনের আগষ্টের সেই ভয়াল রাতে প্রান হারাতে হয়েছে।
মাতুয়াইল গ্রামে ওবায়দুল্লাহর বন্ধুদের বাড়ি থেকেও দাওয়াত আসতো। বন্ধুর বিদায় উপলক্ষে সিলেট থেকে চলে এসেছে পত্রমিতা! এটা তাদের বিশেষ কৌতুহলের বিষয় ছিল। সে গ্রামে অতিথি আপ্যায়নের একটি প্রক্রিয়া চোখে লাগে খুব।
ভাত খাবার আগে প্লেটে দেয়া হতো কোন একটি মিষ্টান্ন। এরপর ভাত-তরকারি। ওবায়দুল্লাহকে মজা করে বলতাম অতিথি যাতে ভাত কম খায় এরজন্যে আগে মিষ্টান্ন দেয়া হতো। সরল হাসি হাসতো আমার বন্ধু।
সেই ওবায়দুল্লাহকে বিমান বন্দরে সি-অফ করে আবার ফিরে গেলাম সিলেটে। এরপর সৌদি আরবে চিঠি লেখা চলে। সে পর্ব অবশ্য বেশিদিন চলেনি। কারন সৌদি আরবে চিঠি পাঠানোর খরচ বহনের সামর্থ্য তখন ছিলোনা।
এরপর পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময়ও মৃধাবাড়ি গিয়েছিলাম। ওবায়দুল্লাহ নেই। তার ছোটভাই নাসিরুল্লাহ মৃধা ছিল বাড়িতে। সেও তখন আমার পত্রমিতা। ঢাকায় যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন অবশ্য ওবায়দুল্লাহ দেশে ফিরে এসেছে।
কিন্তু আমার বন্ধু তখন আর লেখালেখি করেনা বা সে সময় তাঁর নেই। নবাবপুরে তখন তাদের ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর ব্যবসা। ওবায়দুল্লাহ ব্যস্ত ব্যবসায়ী। কোন কারনে কখনো নবাবপুরের দিকে গেলে ওবায়দুল্লাহর সঙ্গে দেখা করি।
যত্ম করে বসিয়ে চা খাওয়ায় আমার পত্রমিতা। আমার সাবেক এক ফেসবুক আইডি অনেক দিন রিমেমবারিং সাইটে ছিল। কেউ একজন রিপোর্ট করেছিল আমি মারা গিয়েছি। সেই আইডিটা একদিনের জন্যে ফেরতও পেয়েছিলাম।
সেদিনই কথা হয় নাসিরুল্লাহ মৃধা সেলিমের সঙ্গে। তাদের পরিবারের কেউ আর মাতুয়াইলে থাকেননা। কেউ বারিধারায় কেউ গুলশানে। মাতুয়াইল মৃধা বাড়ির সেই পুকুরও আর নেই। সেটি ভরাট করে সেখানে সেলিমের কারখানা।
দিন এভাবেই যায়। পুরনো আইডি আবার হারিয়ে গেলে সেলিমকেও আমি হারিয়ে ফেলি। এই আইডতে হঠাৎ একদিন নক করে ওবায়দুল্লাহ, -বদরুল কেমন আছে। তাকে দেখে স্মৃতিকাতর হই। দাঁড়ি রেখেছে ওবায়দুল্লাহ। চিনতে পারছিলাম না।
তাঁর আইডিতে গিয়ে পুরনো সময়ের এই একটা ছবিই খুঁজে পেয়েছি। তাঁর এই ছেলেটাও এখন বড়সড়। আমাদের সময়ে পত্র মিতা-পত্র মিতালি এসব ছিল সামাজিক সম্পর্ক গড়া, ভাববিনিময়ের বিশেষ একটি অবলম্বন। সোশ্যাল মিডিয়া।
এখন আমাদের ফেসবুকে হাজার হাজার বন্ধু। কেউ কাউকে চিনিনা জানিনা। এই সম্পর্ক ভার্চুয়াল। ভালোবাসাবাসিও কম। আমাদের পত্র মিতালির বন্ধু ওবায়দুল্লাহদের সঙ্গে সম্পর্কও ছিল আন্তরিক-নিবিড়। ভালো থাকিসরে ভাই।