মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক তোয়াব খানের ৮৬ তম জন্ম বার্ষিকী ছিল ২৪ এপ্রিল। কিংবদন্তীর এই সাংবাদিককে আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়নি! এ নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে অবাক জেনেছি গত তিন বছরের স্বাধীনতা পদকের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর নামটি কেটে বাদ দেয়া হয়েছে!
বাংলা সাংবাদিকতার চরম এক সাম্প্রদায়িক সময়ে তোয়াব খান সাংবাদিকতায় আসেন। আমাদের প্রজন্ম সাংবাদিকতার সেই অন্ধকার সময়ের কথা জেনেছি আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখায়। মাত্র তখন ভারত মাত্র ভাগ হয়েছে। ‘কলকাতার দৈনিক বসুমতী তখন যদি খবর দেয় ‘ঢাকায় পাঁচজন হিন্দুকে খুন করা হয়েছে’, তাহলে ঢাকার দৈনিক আজাদ খবর দেয়, ‘কলকাতার বেহালায় দশজন মুসলমান তরুণীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে।’
এভাবেই প্রচারণা ও পাল্টা প্রচারণা দ্বারা দুই বাংলায়ই সাম্প্রদায়িক অশান্তি জিইয়ে রাখা হয়েছে। যার পরিণতি ১৯৫০ সালের ভয়াবহ দাঙ্গা এবং নেহরু-লিয়াকত চুক্তি’! সেই সময়ে মাওলানা আকরাম খাঁ পরিবারের সদস্য তরুন তোয়াব খান তখন সাংবাদিকতায় আসেন।
সব সময় তিনি অনেক পড়াশুনা করতেন। ভালো লিখতেন। পরিশ্রম করতেন। তাই পেশায় তরতর করে এগিয়েছেনও। দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার যত প্রতিষ্ঠান আছে এর প্রায় সবক’টির বিকাশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তোয়াব খান।
১৯৫৩ সালে কে জি মুস্তফার সাপ্তাহিক জনতার মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়। সংবাদ পত্রিকায় যোগ দেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৬২ সালে সংবাদের বার্তা সম্পাদক হন। দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালে হন দৈনিক বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক। ওই সময়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পূর্বদেশ পত্রিকার বিরুদ্ধেও তাকে কলম ধরতে হয়েছে। লিখতে শুরু করেন সত্যমিথ্যা মিথ্যাসত্য’ নামের কলাম।
তোয়াব খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব ১৯৭৩-৭৫ মেয়াদে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে স্নেহ করতেন। সেই থেকে সাংবাদিক তোয়াব খান তাঁর কালের বহুকালের সাক্ষী।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর ডিকটেশন তোয়াব খান, আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে দিতে শুরু করেছিলেন। শেষ করার সময় পাননি। সেটিই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শিরোনামেই সংঘবদ্ধভাবে বের করে আলোড়ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বও। এর কারনে জিয়া এরশাদের শাসনকালের নানাকিছু তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে।
১৯৮৭-৯১ মেয়াদে তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রেসসচিব। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিকের ভূমিকায় থাকা তোয়াব খানের তীক্ষ লেখনী আর আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় নিয়মিত প্রচারিত হয়েছে ‘পিন্ডির প্রলাপ’। তোয়াব খানকে ২০১৬ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পুরস্কার দেয়া হয়।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এই জীবিত কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিককে সম্মান জানাতে কলকাতা বইমেলাও তাঁকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ পরিস্থিতির বাস্ত এক সত্য তথ্য হচ্ছে, ৮৬ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিককে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়নি!
বাংলাদেশে এখন আবেদন করে এসব পুরস্কার নিতে হয়! অতএব ‘বুদ্ধিমানরা’ (!) তাঁকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে তাঁকে তালিকা ছাড়া করে তাঁরও আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান একুশে পদক-স্বাধীনতা পদক বগলদাবা করে নিয়েছেন! এতে লজ্জিতরা গত টানা তিনবছর স্বাধীনতা পদকের তালিকায় তাঁর নাম তুলেছিল।
সর্বশেষ গত স্বাধীনতা পদকের আগে দেশের আরেক কিংবদন্তী সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তোয়াব খানের নামটি লিখিতভাবে প্রস্তাব করে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও আলাপ করেছিলেন। এরপরও কিভাবে তাঁর নামটি স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা থেকে কেটে দেয়া হয়েছে, এ নিয়েও একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হতে পারে।
একুশে পদকও তাঁকে দেয়া হয়েছে তাঁর অধীনে কাজ করা অনেকেরও পরে! এমন দেশ তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার না দিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিকতার দিকপাল তোয়াব খানের গৌরব-কীর্তি কেউ কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি।
কিংবদন্তীর মুক্তিযোদ্ধা তোয়াব খান এখনও সাংবাদিকতায় সক্রিয়। ২৪ এপ্রিল ছিল তাঁর ৮৬ তম জন্মবার্ষিকী। সাংবাদিকতায় স্যার শব্দটি নেই। তাই জনকন্ঠ অফিসে তিনি এখনও তোয়াব ভাই। আজীবন সবার তোয়াব ভাই।
আর মহীরুহ তোয়াব খান এখনও সাংবাদিকতার জীবন্ত এক কিংবদন্তী। তাঁর কালের গত কয়েক কালের অনেক সাংবাদিকের শিক্ষকের নামও তোয়াব খান। বাংলাদেশের যে সব সাংবাদিকের তোয়াব খানের কাছে কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে আমি তাদের মধ্যে সৌভাগ্যবানদের অন্যতম।
আমাদের প্রজন্মের অনেক সাংবাদিকের স্রষ্টা মিনার মাহমুদ। তাঁর হাতে সৃষ্ট অনেক সাংবাদিক পরবর্তীতে ঢাকার অনেক মিডিয়ার নেতৃত্বে ছড়িয়ে পড়েন। এখন যত সাংবাদিক ঢাকার প্রধান প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সৃষ্টি-বিকাশ হয়েছে তোয়াব খানের হাতে।
১৯৯৬ সালের মে মাসে সাংবাদিক আমান উদ দৌলার মাধ্যমে জনকন্ঠের মতিঝিল অফিসে ডেকে নেয়া হয়। আমান উদ দৌলা আমাদের সঙ্গে বিচিন্তায় কাজ করতেন। বিচিন্তা টিমে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র।
চারন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন ততোদিনে সংবাদ ছেড়ে জনকন্ঠে কাজ করতে করতে এক ফেরী দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। মোনাজাতউদ্দিনকে সংবাদ যেভাবে ধারন করেছিল জনকন্ঠ সেভাবে পারেনি। কিন্তু জনকন্ঠে এসে তাঁর মৃত্যু হওয়ায় পরিবারটি তখন তাৎক্ষনিক দূর্যোগ থেকে বেঁচে যায়।
কারন জনকন্ঠ তখন শুধু তাঁর পরিবারকে ইন্সুরেন্সকে ক্ষতিপূরনের টাকা নয়, পাঁচ বছর ধরে পরিবারটিকে তাঁর বেতনের টাকাও নিয়মিত দিয়ে যায়। এর কারন ছিলেন তোয়াব খান। জনকন্ঠের উজ্জ্বল সময়ে মালিকপক্ষের কাছ থেকে তোয়াব খান এভাবে সাংবাদিকদের পাওনা আদায় করে দিতে জানতেন।
মোনাজাতউদ্দিনের পর যশোরে গুলিতে নিহত সাংবাদিক শামছুর রহমানের পরিবারকেও ইন্সুরেন্সের ক্ষতিপূরনের টাকা সহ পাঁচবছর ধরে তাঁর বেতনের টাকা দিয়ে গেছে জনকন্ঠ। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় সম্ভবত এমন নজির দ্বিতীয়টি নেই। কারন ওই সব প্রতিষ্ঠানে একজন তোয়াব খান নেই।
শামছুর রহমান সম্ভবত সেই সময়ে ঢাকার মিডিয়ায় ঢাকার বাইরে থেকে কর্মরত প্রথম বিশেষ সংবাদদাতা ছিলেন। তখনও বিশেষ সংবাদদাতা পদটি ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্যে নির্ধারিত ছিল।
সাংবাদিক বিপদগ্রস্ত হলে তোয়াব খান কি ভূমিকা নেন তা প্রবীর শিকদারও জানেন। তাকে মেরে ফেলতে গুলি চালানো হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও একটি পা হারিয়ে সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু হয়ে যান একজন শহীদের সন্তান প্রবীর। মূলত তোয়াব খানের ভূমিকার কারনেই আমরা জনকন্ঠ পরিবার তখন প্রবীরের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। তখন প্রবীরের চিকিৎসার খরচ অবশ্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জনকন্ঠের উজ্জ্বল সময়ে দেশের অস্বচ্ছল শিল্পী সাহিত্যিক ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবছর জনকন্ঠ পদক নামের এককালীন অর্থ ও মাসিক ভাতা দেয়া হতো। এর নেপথ্যের ব্যক্তিটিও ছিলেন তোয়াব খান।
১৯৯৬ সালে মূলত মোনাজাতউদ্দিনের শূন্যপদে কাজ করানোর জন্যে তোয়াব খান আমাকে ডেকে নিয়ে জনকন্ঠে চাকরি দিয়েছিলেন। কারন আমার সারা বাংলাদেশ পায়ে হেঁটে ভ্রমন, এর আগেও সারাদেশ ঘুরে ঘুরে রিপোর্ট করার কথাটি তিনি জানতেন। আমি তখন পূর্বকোনের ঢাকা ব্যুরো প্রধান হিসাবে কাজ করতাম।
কিন্তু জনকন্ঠে শুরুর দিকে আমি মোটেই সুবিধা করতে পারছিলামনা। এর কারন হলো প্রথমত আমি মোনাজাতউদ্দিনের সমান যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলামনা। দ্বিতীয়ত, ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিন অনেক রিপোর্ট পাঠালেও ঢাকার রিপোর্টের চাপে এর খুব কমই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছিল।
তখন ভয়ে ভয়ে একদিন তোয়াব ভাইকে ফোনে বললাম আমি কিছুদিনের জন্যে ঢাকায় আসতে চাই। তিনি এক শব্দে ‘আসো’ শব্দটি বলেই ফোন রেখে দেন। আমিও ঢাকায় ফিরে মিশে গেলাম পত্রিকাটির মূলধারায়।
তখন মতিঝিলের এক ছোট পরিসরের অফিসে জনকন্ঠ পত্রিকার অফিস। নতুন আরেকজন রিপোর্টারকে চেয়ার টেবিল দেবার জায়গা হলোনা। নিজের কোন চেয়ার টেবিলের কথাও ভাবলামনা।
রিপোর্টিং মিটিংএ খেয়াল রাখতাম দিনের কোন রিপোর্টে তোয়াব ভাইর আগ্রহ। সেই রিপোর্টের আলোচনায় অংশ নিতে অনেক সময় সে রিপোর্টের দায়িত্ব পেয়ে যেতাম। খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারির এক তরফা নির্বাচন শেখ হাসিনার গনকার্ফুর আন্দোলনে বাতিল হয়ে গেলে দেশে তখন নতুন নির্বাচনের ঢামাডোল চলছিল।
আমাকে তখন কখনো শেখ হাসিনার সঙ্গে কখনো খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঢাকার বাইরে পাঠানো হচ্ছিল। জনকন্ঠের রিপোর্টিং মিটিঙে থেকে থেকে ততোদিনে বুঝে গেছি ‘শেখ হাসিনা বলেন’ বা ‘খালেদা জিয়া বলেন’, বা ‘তিনি আরও বলেন’, ‘তিনি জোর দিয়ে বলেন’ এ ধরনের বস্তাপচা রিপোর্টের চাইতে জনসভার বর্ননামূলক রিপোর্ট বেশি পছন্দ করেন তোয়াব খান।
রিপোর্ট লেখার সময় তোয়াব ভাইর চেহারাটা চোখের সামনে ভাসতো। ভাবতাম কিভাবে সূচনা লিখলে রিপোর্ট তোয়াব খান পছন্দ করবেন। সেভাবেই লিখতাম। রিপোর্ট খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো। জনকন্ঠের সাংবাদিক অনেকের এমন তাঁকে ঘিরে এমন আলাদা অভিজ্ঞতা-মূল্যায়ন আছে।
আমি আমার সহকর্মীদের মজা করে বলতাম তোয়াব ভাই পাঠকের পার্লস বোঝেন। কাজেই রিপোর্ট লেখার সময় মাথায় রাখবেন রিপোর্ট কিভাবে লিখলে তোয়াব ভাই তা পছন্দ করবেন। তোয়াব খান পছন্দ করলে রিপোর্টের ভালো শিরোনাম-ট্রিটমেন্ট হবে। রিপোর্ট তোয়াব ভাই পছন্দ না করলে সেটি হয়তো কখনো ছাপাই হবেনা। অথবা পরের দিন ছাপা হবে পত্রিকার ভিতরের কোন পাতায়।
হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে তোয়াব ভাই অনেক সময় নিজে রিপোর্টের এন্ট্রু লিখতেন। তাতেই পুরো একটি রিপোর্টের আবেদন বদলে যেতো।
১৯৯৬ সালের সেই নির্বাচনে আওয়ামী ২১ বছর ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলো। তোয়াব ভাই তখন প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ট্যুর নিয়ে একটি প্রস্তাব করেছিলেন। প্রস্তাবটি ছিল সরকারি মিডিয়ার বাইরে বেসরকারি মিডিয়া যেহেতু একটি ব্যবসা তাই বেসরকারি মিডিয়ার রিপোর্টার-ফটোগ্রাফাররা যার যার প্রতিষ্ঠানের খরচে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সহায়তায় সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার-ফটোগ্রাফারের ভিসাসহ প্রটোকলগত সহায়তার ব্যবস্থা করবেন।
সরকারি খরচে দলীয় সাংবাদিকদের বিদেশ ভ্রমন বিশাল এক ব্যয়-বরাদ্দের বিষয়। যারা সরকারি খরচে এভাবে বিদেশ যেতে চান তাদের প্রভাবে তোয়াব খানের সেই প্রস্তাব গ্রহন করা হয়নি। জনগনের টাকার মচ্ছব ঘটিয়ে একদল সাংবাদিকের এভাবে বিদেশ ভ্রমন এখনও চলছে।
বাংলাদেশে প্রোস্টাবলিস্টমেন্ট ধারার পত্রিকা চলেনা। সে কারনে তোয়াব ভাই চিন্তা করলেন জনকন্ঠের পাঠকপ্রিয়তা ধরে রাখতে এমন কিছু করতে হবে তা অন্য পত্রিকায় নেই। এ চিন্তায় সিদ্ধান্ত হলো সারা বছর জনকন্ঠের কোন একজন সাংবাদিক বিদেশে থাকবেন। সেখান থেকে পাঠাবেন এমন কোন রিপোর্ট যা ঢাকার আর কোন কাগজে নেই।
সে চিন্তায় আমাকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশে পাঠানো হলো মিসর-জর্দানে। ফিলিস্তিনে যাবার ভিসা অথরিটি ইসরাইল। মিসর-জর্দান থেকে ফিলিস্তিনে যাতায়াতের সীমান্ত চেকপোষ্টের নিয়ন্ত্রনও ইসরাইলি সীমান্তরক্ষীদের হাতে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাই তখন বাংলাদেশের পাসপোর্টে ফিলিস্তিনে যাওয়াও সম্ভব ছিলোনা।
ঢাকায় তখন শাহতা জারাব ছিলেন ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত। তাঁর সহায়তা চাইতেই তিনি পিএলও’র কায়রো ও আম্মান মিশনকে চিঠি লিখলেন আমাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে। কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখে তারা চেষ্টা করেও পারলোনা।
অতঃপর কায়রো-আম্মানের স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তা, ফিলিস্তিনের ভিতরে থাকা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সহায়তায় প্রতিদিন রিপোর্ট লিখে প্রতিদিন তা ফ্যাক্সে ঢাকায় পাঠাই।
তখন আমাদের হাতে কম্পিউটার-ইন্টারনেট উঠেনি। সাদা কাগজে রিপোর্ট লিখে প্রতিদিন ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠাতাম। ফ্যাক্স অফিসে গেলো কিনা পড়া যায় কিনা তা আবার ফোন করে জানতে হতো। তখন পত্রিকার আজকের মতো অনলাইন ভার্সনও নেই। তাই রিপোর্ট কিভাবে ছাপা হচ্ছে বা আদৌ হচ্ছে কিনা তা জানার সুযোগ ছিলোনা।
কিন্তু প্রতিদিন আমি আমার রিপোর্টের আপডেট জানতাম! প্রতি রাতে অফিস থেকে যাবার আগে আমার কায়রোর হোটেলে ফোন করতেন তোয়াব ভাই। জানতে চাইতেন আমার ভালোমন্দ। তখন তার কাছে জেনে নিতাম আজ কি ছাপা হয়েছে। কাল কি ছাপা হবে। আর কি কি রিপোর্ট করা যায় সে পরামর্শ তখন দিয়ে দিতেন।
সেই সময় কায়রো থেকে ফিলিস্তিন যাবার আশা না দেখে চলে গেলাম জর্দানের আম্মানে। সড়ক পথে যেতে গিয়ে প্রথমে বাসে পরে ডেড সী ধরে জাহাজে করে যেতে হয়েছে আকাবা বন্দরে। সেখান থেকে আবার বাসে আম্মান।
আবার সংগ্রাম শুরু। প্রতিদিন রিপোর্ট পাঠানো এবং প্রতি রাতে তোয়াব খানের ফোন! বাংলাদেশের আর কোন সাংবাদিকের জীবনে সম্ভবত এমন অভিজ্ঞতা নেই। টানা তিন মাস এভাবে প্রতিদিন ফোন করে একজন রিপোর্টারের খোঁজ নেয়া! কারন তাদের অফিসে যে একজন তোয়াব খান ছিলোনা। একবার আমার হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলো। আমেরিকা থেকে ডলার চলে গেলো আমার কায়রোর ঠিকানায়। কারন তোয়াব খান যে আমাদের গুরু। পিতা। বড়ভাই।
এভাবে কোনভাবে ফিলিস্তিন যেতে পারছিনা দেখে একদিন আম্মান থেকে বাসে করে চলে গেলাম পশ্চিমতীর সী্মান্তে। বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে আমরা ভারত সীমান্ত দেখে অভ্যস্ত। কোথাও নদী বা কোথাও স্থল সীমান্ত। কিন্তু পশ্চিমতীরে গিয়ে দেখি শুধু ধু ধু মরুভূমি!
রাতে তোয়াব ভাই ফোন করলে বললাম এভাবে যে মরুভূমির সীমান্ত দিয়ে ঢুকে যাব সে অবস্থাও নেই। এবার শাসন করলেন তোয়াব ভাই। বললেন তোমার এভাবে রিপোর্টের জন্যে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে আরেক দেশে যাবার দরকার নেই। দেশে ফিরে এসো। ফিরে এলাম দেশে।
তোয়াব খানের কারনে আমার ইরাকে-লেবাননে, আরব আমিরাত, সিরিয়ায়, উজবেকিস্তানে, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া, ব্রিটেন সহ নানা দেশে গিয়ে রিপোর্ট করার সুযোগ হয়েছিল। অনেক দেশের ট্যুরিজম বোর্ড, এয়ারলাইন্সও আমাকে তাদের দেশ দেখাতে নিয়ে যেতো।
তারাও হয়তো জেনে গিয়েছিল এই রিপোর্টার বেশি লেখে। তোয়াব খানের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো। একে নিয়ে গেলেই বেশি বেশি রিপোর্ট লিখবে-ছাপবে! একটা রিপোর্ট খুব পাঠকপ্রিয় হতো, যেমন, ‘উজবেকিস্তানের পথে পথে’।
একবার আমাকে ভারতের নির্বাচনে পাঠানো হলো তিন মাসের জন্যে। সারা ভারত ঘুরে রিপোর্ট করা বিশাল অভিজ্ঞতা। উত্তর প্রদেশের রায় বেরিলিতে প্রিয়াংকা গান্ধীর জনসভার রিপোর্ট করতে গেছি।
খবর পেয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মঞ্চ থেকে বললেন বাংলাদেশ থেকে এক সাংবাদিক এসেছেন রিপোর্ট করতে। তাকে সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। করতালিতে মুখরিত হলো পুরো এলাকা। তোয়াব খানের মুখটা মনে পড়তেই এ নিয়ে আলাদা রিপোর্ট করলাম। সে রিপোর্ট বক্স ট্রিটমেন্টে আলাদা করে ছাপা হলো জনকন্ঠে। সে রিপোর্টের কথা এখনও অনেকে মনে করেন।
তোয়াব ভাই এমন আমাদের সময়ের সামনে থেকে দেয়া নেতৃত্ব। আমাদের সময়ের সাংবাদিকতার সেরা শিক্ষক। তোয়াব খানের কাছে যারা শেখার সুযোগ পায়নি, তোয়াব খানের বকা খায়নি তারা হতভাগ্য। জন্মদিনে তাঁর প্রতি অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। অনেক ভালো থাকবেন প্রিয় তোয়াব ভাই। বাংলাদেশ যেন আপনার জীবিতাবস্থায় আপনার হাতে স্বাধীনতা পদক তুলে দিয়ে নিজের অপরাধমোচনের সুযোগ পায়।