“আজ আমাদের ছুটি রে ভাই,
আজ আমাদের ছুটি’ “
মনে মনে গাইছি আনন্দে আত্মহারা হয়ে হোটেল রুম ত্যাগ করে যখন বাইরে বের হোলাম , ঝির ঝির বৃষ্টি সাথে একটা মিঠে ঠাণ্ডা বাতাস এসে যখন গায়ে ধাক্কা লাগলো । আহা এই হাওয়ার স্পর্শ যেন অমোঘ । তার উপরে আরও আনন্দ আজ তিন মাস পর বাড়ি ফিরবো ।
সারা বিশ্ব গ্রাস করে ফেলছে একটি ক্ষুদ্র স্পাইক ওয়ালা অণুজীব। করোনাভাইরাস , কোভিড-১৯ এই নামেই তো চিনছে সবাই ।এই মহামারিটি মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানেই ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বের প্রায় সব দেশে। কিছু দেশের মৃত্যুর মিছিলের বহর দেখে , কখনো কখনো মনে হয়েছে এবার বুঝি আমার পালা । আর রক্ষা নাই । সব দিকে লকডাউন , অষ্ট্রেলিয়া ফেরবার পথ গুলো বন্ধ , দেশে গিয়েও গ্রামের বাড়িতে অবরুদ্ধ । প্রতিমিনিট যেন ভারী নি:শ্বাস ফেলে কাটাতে হয়েছে । অবশেষে যখন ফিরলাম অষ্ট্রেলিয়া , তখন মনের মাঝে একটু শান্তির সলতে আনন্দে ভিজে গেল । তারপর এদেশের নিয়ম মানার পালা , আমাদের জন্য পাঁচ তারা হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা , চিকিৎসা পরামর্শ , কোভিড টেষ্ট , এবং বাহারী খাবার দিয়ে ভালোবাসার অত্যাচারে আমাদেরকে তুলতুলে আদরে রেখেছেন … এদেশের সরকার । যাকে হোটেল কোয়ারেন্টাইন বলে ।
হোটেল , সুবিধা সবই ঠিক ছিল , কিন্তু খাবার গুলো আমাদের রসনা উপযোগী ছিল না মোটেও , মাঝে মাঝে ভেতো বাঙ্গালীর ভাত নেশা পেয়ে বসতো । কোন মতো সেটাও ম্যানেজ করে বেঁচে থাকা গেলো ১৪ দিন । বদ্ধ ঘরে … শরীর গড়াবার জন্য কিং সাইজ বিছানা , আর ছিল জায়েন্ট উইন্ডো। খুলবার জো নেই , সেটা দিয়েই উঁকি দিতাম অচেনা শহরের রকমারী ডিজাইনের অট্রালিকায় । মাঝে মাঝে ট্রেন ক্রসিং , সাদা কবুতরের মজমা দূর থেকে দেখতাম । এই করেই দীর্ঘশ্বাসের ভাপর ফুলিয়ে ফুলিয়ে
শেষ হলো আজ কোয়ারেন্টাইনের শেষ রাত । আমাদের ছুটি ।
যে ছুটি বহু প্রতীক্ষার, যে ছুটি আনন্দের।
কিন্তু মৃত্যুর গন্ধ বেয়ে যে ছুটি আসে সে ছুটি কতটুকু বা আনন্দের থাকে ? বিষাদের, ও নিরানন্দের হতে এতোটুকুও সময় লাগে না ।
হোটেল কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়পত্রের জন্য দাঁড়াতেই পেছনের একজন বল্লো … আহা ! পরিবার টা ভালো আছে তো ! কোন পরিবার , আবার কি হলো ? জিজ্ঞেস করতেই শুনলাম , আমরা যে স্পেশাল প্লেনটাতে আসছি সেটাতেই এক পরিবার এসেছিল যাদের করোনা পজেটিভ। ওদেরকে হাসপাতালে শিফ্ট করা হয়েছে । সবাই বলছে ভালো আছে । মনটা কিছুটা হতাশায় ছেয়ে গেল । তবু ভালো এদেশে ভালো চিকিৎসা হবে , যত্নও পাবে । দেশের যা অবস্থা , ওখানে থাকলে কি হতো আল্লাই জানে ! আল্লাহ সহায় ।
আমরা ম্যাক্সি টেক্সিতে চেপে বসলাম , এয়ার পোর্টের উদ্দেশ্যে মানে আমার সুইট হোমের উদ্দেশ্যে ।
বহুদিন পর বাসায় ফেরার আনন্দে যেন আত্মাহারা আমরা । বাচ্চারা খোলা বাতাসে বেশ সতেজ হচ্ছে , ছোট মেয়েটা অচেনা শহরের রাস্তা , অন্যান্য জিনিস গুলোর সাথে আপন স্টেটের সাথে মেলাচ্ছে । কোনটা ভালো , কোনটা মন্দ ।
এয়ারপোর্টে এসে যখন অপেক্ষা করছি কখন উঠবো এয়ারে … যদিও জানি আবার অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে হবে বাড়িতে, তবুও যেন আনন্দ অপার ।
আমার একঝাঁক ঘুঘু , আমার ফল ফলাদীর গাছ , ফুলের গাছ গুলো …. সবাই হয়ত আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে ।
ফ্রান্ট ইয়াডের সবুজ একটু ঘাসের উঠোন , যেখানে আমি খালি পা ডুবিয়ে মাঝে মাঝেই শিশির মাখি ।
মনের মধ্যে যেন মৃত্যু ভয় , করোনার কথা , তিন স্তরের মাস্ক ,পরার কথা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল ।
কেবলই মনে হলো আহা … সুইট হোম ।
বড্ড মায়া ।
যখন প্লেনে উঠবো তখনি মনে হলো আমরা আমাদের ছোট্ট একটা বক্স … মানে বিডি থেকে নিয়ে আসা বিরিয়ানি পট ভুলে রেখে আসছি ।
আমার হাসব্যন্ড এতোই অস্থির হলো , যেন আর পাওয়া যাবে না ।
আমি মোটেও চিন্তিত নই , আমার বিশ্বাস , এই দেশে ইনফরমেশন থাকলে কিছুই খোয়া যায় না ।
যে কথা তাই হলো ! ওদের ফোন করতেই বল্লো পোস্ট করে
দেবে । অবশেষে আমরা ফিরলাম আবার অবরুদ্ধ হবার জন্যই । অফুরন্ত সময় । অনেক দিনের ছুটি ।
কিন্তু এই ছুটিতে কোনো আনন্দ নেই।
প্রতিটা মুহূর্ত আতঙ্ক , ভয় , হতাশা, জীবন মানেই হয়তো অনিশ্চয়তা, কিন্তু এই মুহূর্তে অনিশ্চয়তা বহুগুণ বেড়ে গেছে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মনে ।
হোমকোয়ারেন্টাইনে দিন গুলো কাটছে ঠিক ঠাক , তবুও যেন কোথায় মনের মাঝে ভয় , কি জানি কি হয় ।
একটাই আকুতি প্রাণে
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে
মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
দার্শনিক বোধ তাড়িত সময় সচেতন নিষ্ঠাবান কবি। চলমান বাস্তবতাকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরায় জারিত করে তিনি কাব্য রূপান্তরে অভ্যস্ত। কাব্য রচনার পাশাপাশি ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী মৌলিক গবেষণা ও কথাসাহিত্য সাধনায় তাঁর নিবেদন উল্লেখ করার মতো। গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্যঃ জারিগানের আসরে “বিষাদ-সিন্ধু” আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থের জন্য সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১২ অর্জন করেছেন।