রোজা পালনের মূল উদ্দেশ্য সংযম সাধনের প্রশিক্ষণ নেওয়া। পরমসত্তা আল্লাহর ভয়ে দেহ-মন সবকিছুকে সংযত রাখাই হলো রোজা বা সিয়াম সাধনা। তাই অশুভ কামনা-বাসনা লোভ লালসা তথা ভোগস্পৃহা দমন এবং বৈধ বাসনা ও ইন্দ্রিয়সুখকেও নিয়ন্ত্রণ করতে না শিখলে সিয়াম সাধনার সার্থকতা থাকে না। অথচ একশ্রেণির মানুষ রোজা থাকা অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত কেনাকাটা করেন। তাদের এই ধরনের উগ্রভোগবাদিতার প্রভাবে বা কারণেই অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে কোনো কোনো ব্যবসায়ী অতিমাত্রায় মুনাফা অর্জনের বাসনা থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে থাকে। তাদের এই আচরণও সংযমের খেলাপ। তাই তারা যদি রোজাদারও হন তাহলে তারাও সিয়ামের মূল শিক্ষা সংযমের আদর্শ থেকে সরে যান বলা চলে।
সংযমী হওয়া নৈতিকতার একটি পূর্বশর্ত। যে সংযমী হতে পারে না তার পক্ষে নৈতিক হওয়াও সম্ভব নয়। তাই একমাত্র স্থূল আত্মসুখবাদী তথা উগ্রভোগবাদী ছাড়া সকল নীতিদার্শনিকই সংযমী হবার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব। জীববৃত্তির দিক দিয়ে মানুষ অন্যান্য প্রাণির মত ক্ষুধা, তৃষ্ণাসহ নানারকম প্রবণতার ধারক। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির কারণে অন্যান্য প্রাণি থেকে মানুষ শ্রেষ্ঠ। তবে বুদ্ধি বিবেক দিয়ে জৈব প্রবৃত্তিগুলোকে পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে না।
দার্শনিক প্লেটো মানবাত্মাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন : ক্ষুধা আত্মা, সাহস আত্মা এবং বুদ্ধি আত্মা। তার মতে, আত্মার এই তিনটি অংশ সমন্বিতভাবে কাজ করার মধ্যেই মানবজীবনের পূর্ণতা বা সার্থকতা নির্ভর করে। তিনি আত্মার বুদ্ধিময় অংশ দ্বারা অন্য দু’টো অংশকে পরিচালিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ইসলামেও আত্মার প্রধান তিনটি ভাগ স্বীকার করা হয়, তা হলো : নাফ্সে আম্মারা, নাফ্সে লাওয়ামা ও নাফ্সে মোতমাইন্না। নাফ্সে আম্মারার মধ্যে কামনা-বাসনা, লোভ-লালসাসহ সর্বপ্রকার ভোগলিপ্সা থাকে। নাফ্সে লাওয়ামা নিষেধ আত্মা। এই আত্মা পরিশীলিত, পরিমার্জিত আচরণের প্রতি তাগিদ দেয়। আর নাফ্সে মোতমাইন্না হলো পরিতৃপ্ত আত্মা যা সর্বপ্রকার লোভ-লালসা মুক্ত এবং আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী। এই আত্মাকেই আল্লাহ বেহেস্তে প্রবেশ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মাকে এই অবস্থায় উন্নীত করার পথ সুগম হয়।
দার্শকি ইমানুয়েল কাণ্ট (১৭২৪-১৮০৪) মানুষকে একই সাথে ইন্দ্রিয় জগতের এবং বুদ্ধি জগতের সদস্য বলে অভিহিত করেন। ইন্দ্রিয় জগতের সদস্য হিসেবে মানুষ নানারকম বাহ্যিক প্রবণতার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। কিন্তু বিশুদ্ধ বুদ্ধির জগতের সদস্য হিসেবে মানুষ তার নিজের মধ্যে নৈতিক আদর্শ উপলব্ধি করে।এই বুদ্ধি প্রসূত আদেশ বা নৈতিক নির্দেশ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ যখন কাজ করে তখনই তার কাজকে ভালো বলা যায়। তখন তার আচরণ হয় সংযমী। কিন্তু এই সংযমের শৃঙ্খল ছিঁড়ে মানুষ যখন বাহ্য জগতের নানারকম ভোগ-বিলাসে নির্বিচারভাবে লিপ্ত হয়, নিজেকে নিমগ্ন করে তখনই মানুষ হয়ে পড়ে বাহ্য জগৎ দ্বারা প্রভাবিত এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরিচালিত। ইন্দ্রিয়ের জগতের প্রভাব দ্বারা মানুষ যখন কাজ করে তখন মানুষ তার নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মূল নিয়ামত তথা বুদ্ধিবৃত্তিকে পরাজিত করে ফেলে। এই অবস্থাকে কান্ট পরাধীনতা বলেছেন।
মানুষ যখন তার নিজের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা বাইরের প্রভাব তথা লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হতে পারে তখন তার বাইরের জগতের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ করা তথা ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়। তখন তার কাজগুলো নৈতিক হয়ে ওঠে। কান্টীয় নীতিদর্শনে নৈতিক জীবনের যে তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় সে রকম নৈতিক জীবনের প্রায়োগিকতা আমরা পেতে পারি রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে। কেননা রোজা বা সিয়াম আমাদের ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার প্রশিক্ষণ প্রদান করে, আমাদের সংযমী করে তোলে। সংযম ছাড়া নৈতিক জীবন সম্ভব নয়।
রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সব চেয়ে ভালো যার নৈতিক চরিত্র সব চেয়ে ভালো।’বস্তুত মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে তার নীতি-নৈতিকতা তথা চারিত্রিক গুণাবলীর ওপর। ইসলাম উত্তম চরিত্র গঠনের পর্যাপ্ত দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। শুধু দিক-নির্দেশনা প্রদানই নয়, বাস্তবে চরিত্র গঠনে অনুশীলনও রয়েছে ইসলামে। রোজার মাধ্যমেও এই অনুশীলন হয়ে থাকে।
রমজান মাসের রোজা বহুদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হলো নৈতিক তাৎপর্য। রমজানের রোজা পালনের মধ্যদিয়ে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হতে পারে। যদি সঠিকভাবে রোজা পালন করা হয় তাহলে একজন রোজাদার ব্যক্তিকে আমরা উত্তম চরিত্রের নমুনা বা মডেল বলতে পারি। কেননা, রোজাদার ব্যক্তির কোন ভোগ-মোহ থাকে না। রোজাদার স্বেচ্ছায় খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। দুনিয়ার অনেক অনৈতিক কর্ম ভোগলিপ্সার সাথে সম্পর্কিত। রোজার মাধ্যমে সেই ভোগলিপ্সাকে নিয়ন্ত্রণ করার অনুশীলন হয়ে থাকে।
যৌন-কামনা নৈতিক চরিত্রের জন্য বড় রকমের হুমকি। যৌনতাকে পরিশীলত না করতে পারলে মানবজীবন অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থায় নিপতিত হয়ে পড়ে। রোজা যৌন-কামনা সংযত করার প্রশিক্ষণ প্রদান করে। চোখের দৃষ্টি সংযত করা, মুখ দিয়ে অনর্থক অশালীন কথা না বলা, মিথ্যা কথা না বলা, কাউকে না ঠকানো, গীবত না করা, ঝগড়া-বিবাদ না করা ইত্যাদি সবই রমজানের রোজায় অনুশীলিত হয়। এগুলোর কোনো একটা পালিত না হলে যথার্থভাবে রোজা পালন হয় না। তাই কোনো মানুষ যথার্থভাবে রোজা পালনের চেষ্টা করলে সে অবশ্যই এ সকল বিষয় পালন করতে চেষ্টা করবে। আর এই প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসা সম্ভব।
রমজান মাসে আল্লাহ্ মানুষকে এক মাস রোজা রাখতে বলেছেন। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের থেকে এক মাস রোজা রাখার বিধান আল্লাহ্ নির্দিষ্ট করেছেন। এর পূর্বেও সকল যুগে সকল জাতির জন্য কোনো না কোনো সময় ধরে রোজার বিধান ছিলো। এতে করে বোঝা যায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন রোজাকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। আল্লাহ্ মানুষের স্রষ্টা, তিনিই ভালো জানেন তার সৃষ্টির কল্যাণ কীভাবে সাধিত হবে। দীর্ঘ সময় ধরে রোজা পালনের মধ্যদিয়ে আল্লাহ্ মানুষের নৈতিক চরিত্রকে উন্নত ও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া মানুষকে দান করেছেন।
রমজান মাস মানুষের জন্য তাই একটি বড় নিয়ামতস্বরূপ। আমরা এই নিয়ামতের হক যথাযথভাবে আদায় করে নিজেদের নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে চরিত্রও একটি অভ্যাসগত বিষয়। ভালো কাজ করতে থাকলে এক পর্যায়ে ভালো কাজ করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন খারাপ কাজ করাটাই ঐ ব্যক্তির জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে। রমজানে একমাস রোজা পালনের মধ্যদিয়ে ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা, এমনকি কিছু স্বাভাবিক প্রবণতাকেও দমিয়ে রাখার যে অনুশীলন করা হয় তা সংশ্লিষ্ট মানুষের নৈতিক চরিত্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যে নৈতিক আচরণের প্রশিক্ষণ মেলে তার আলোকে বছরের বাকী দিনগুলোও আলোকিত হওয়া কাম্য। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই যদি তেমনটি দেখা না যায় তাহলে বুঝতে হবে রমজানের সিয়াম সাধনা যথার্থভাবে করা হয়নি। যথার্থভাবে মাসব্যাপী সিয়াম পালন করা হলে তার প্রভাবে মানুষের জীবন অধিকতর নৈতিক মানে উন্নীত হবে এমনটিই আশা করা যায়।
ড. মো. শওকত হোসেন : শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রাকটিক্যাল এথিক্স।