বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন হয় না

টুঙ্গীপাড়ার এক সাধারণ যুবক বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রদর্শক। তাঁর অবিসংবাদিত নেতা হওয়ার কাহিনী এখনো আমাকে ভাবায়। আমি তাঁকে দেখিনি। তাঁর গল্প শুনে বড় হয়েছি। তাঁকে বইয়ে পড়েছিl চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবিতে দেখেছিl অডিও’তে তাঁর দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদী ভাষন শুনেছি।

তিন দশকেরও বেশী সময় পার করেছি আমার জীবনে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে যখনই শেকড় সন্ধান করি ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে যাই। বিস্ময় জাগে, তাঁকে জানার ব্যাকুলতা বাড়েl তিনি একজন অসাধারণ রাজনৈতিক সংগঠক, এক অনলবর্ষী বক্তা এবং অঙ্গীকারদীপ্ত সাধনায় নিবেদিত প্রান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যিনি সারা জীবন বাংলার মানুষের জন্যই কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণের যাঁতাকল থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। এ জন্য তিনি রাজনীতিকে বেছে নিয়েছিলেন লড়াইয়ের মাধ্যম হিসেবে।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা-প্রেম একদিনের নয়। আমি তখন স্কুলে পড়িl ক্লাস সেভেনে। স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটা পর্ব ছিল রচনা প্রতিযোগিতা, বিষয় ছিল – ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’।

পুরুনো পত্রিকা, বই পুস্তক ঘেঁটে নির্ধারিত রচনাটি লিখেছিলাম। সেই থেকে আগ্রহ। বিজয়ী হিসেবে প্রথম হয়েছিলাম, এজন্য পুরুষ্কারস্বরুপ আমাকে একটি বই ও ৫০০ টাকা উপহার দিয়েছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মেজর (অব:) আখতারুজ্জামান রঞ্জন l তখন বুঝিনি। বঙ্গবন্ধু’কে ভালবাসতে হলে কোন রাজনৈতিক লেবাসের প্রয়োজন হয়না।

বর্তমান স্বার্থান্বেষী উশৃঙ্খল অস্থির রাজনৈতিক কর্মকান্ড আমাকে ভাবিয়ে তুলেl এখনকার রাজনীতি ভোগ বিলাসের। ব্যক্তি স্বার্থোন্মত্ত। দেশপ্রেম এখানে গৌন।

সমাজে রাজনীতিতে নানা আদর্শ বা আইডিওলজি সদর্পে আছে এবং থাকবে। প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ আছে। প্রত্যেকের উচিত পরস্পরকে সম্মান করা। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি বঙ্গবন্ধুবিরোধী দল নয়, বরং বঙ্গবন্ধু স্বপক্ষের লোকেরাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানান বিতর্কের সৃষ্টি করছেন। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর কর্মে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম বেচে বিক্রি করে নিজেরা ফায়দা লুটছে। দেশে/বিদেশে যেখানেই বাংলাদেশী আছে সব জায়গার চিত্র এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর নামে একাধিক সংগঠন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মপরিধি আলোচনার চেয়ে দলীয় লোকদের পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা নিন্দা কুৎসা রটনাই যেন বঙ্গবন্ধুর পরিচয়! রাজনৈতিক নেতাগণ এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে চায় যেন সব কিছু তার/তাদের বলয়ে থাকতে হবে। বগলদাবা করে দাবায়ে রাখতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষ বঙ্গবন্ধুর নামে দু’তিনটা সংগঠন থাকতেও পারে। কিন্তু আপত্তির কারন হচ্ছে একমুখী দলীয় করনের প্রভাব খাটিয়ে যখন অন্যপক্ষের বিরোধিতা করা হয়। সাধারন মানুষকে বাঁধা দেয়া হয় বিপক্ষ আয়োজিত অনুষ্ঠানে না যাবার জন্য। এসমস্যাটা বিদেশে প্রবল। প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়া সরকার কর্তৃক দেশীয় রাজনীতি করার অনুমতি নেই। সেটা যে দলই হোক না কেন! দলীয় কোন্দল, বিতর্কের উর্দ্ধে নয় এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো। এরা দল ও দেশের মঙ্গল চাওয়া থেকে নিজেদের ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই এদের ব্যস্ত সময় কাটে।

১৯৭১ সালে হুট করেই নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অভ্যুদয় ঘটেনি। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের গোড়া থেকেই ছিল তাঁর সম্পৃক্ততা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দিয়ে শুরুর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনা পর্যন্ত সারা জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। পাকিস্তান সরকার বারবার তাকে কারারুদ্ধ করেছে।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে পাকিস্তান সরকার প্রথমবারের মতো তাকে গ্রেফতার করে। তারপর আরও বহুবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বন্দি ছিলেন তিনি। সর্বশেষ গ্রেফতার হন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেসময় সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। সামরিক আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বৈশ্বিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়।

এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতার জন্য তিনি সারা জীবন লড়াই করেছেl নেতৃত্ব দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন বাংলার মুক্তিকামী মানুষদের। বাবা-মা, পুত্র-কন্যার ভালবাসা বিসর্জন দিয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। দেশের মানুষও তাঁকে ভালবেসেছে অকৃপণভাবে। ছাত্র-জনতা তাকে আইয়ুব কারাগার থেকে মুক্ত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে অভিষিক্ত করেছে। সেই বঙ্গবন্ধু কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একক সম্পত্তি নয়। বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাংলাদেশের সম্পদ।

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য বহু বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটাতে হয় তাঁকে। ঐসময়ে তিনি নিয়মিত ডায়রী লিখতেন। তারিখ দিয়ে ডায়েরির মতো লিখে গেছেন। যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সহযোগিতায় তা বই আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বইয়ের কোনো নাম দিয়ে যাননি।

মহামূল্যবান বই দু’টি হচ্ছে – একটি ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও অন্যটি ‘কারাগারের রোজনামচা’। বই দু’টি বাঙালির প্রামাণ্যদলিল। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবনের অনেক ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ, প্রাঞ্জল ভাষায় সব কিছু উপস্থাপিত হয়েছে বই দুটোতে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থদ্বয়ে তাঁর সহধর্মিনীর প্রতি গভীর ভালবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন। যা বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন –
“রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোট বেলায় বাবা-মা মারা গেছেন। তোমার কিছু হলে বাঁচব কী করে?”

বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেগম মুজিবের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই মাথাব্যথায় আক্রান্ত হতেন। তাই ব্যথা হলে ব্যথানাশক স্যারিডন সেবন করতেন। বেশি ব্যথা হলে ২-৩টা একসঙ্গে খেয়ে নিতেন। বেগম মুজিব ব্যথানাশক ওষুধ খেতে নিষেধ করতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু খুব একটা আমল দিতেন না। কারাগারে তীব্র মাথাব্যথ্যায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর প্রিয় সহধর্মিণীর কথা মনে পড়েছে।এ অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন –
“রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। আমি বলতাম আমার হার্ট নাই। অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই, কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।”

বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, প্রেমিক স্বামীও বটে!

জেলে থাকা অবস্থায় বিষন্ন মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন –
“জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই তারা জানে না জেল কী জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা।জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।”

উল্লেখযোগ্য আরো কিছু কথা।
৬ দফা দাবী ও আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তৎকালীন গর্ভনর মোনায়েম খান গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও হরণ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম।”

বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন যে, ছয় দফার আন্দোলন নসাৎ করার জন্যই এসব আয়োজন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে লিখেছেন:
“৬ দফার জন্য জেলে এসেছি, বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাটছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে আমি পারব না।”

বাঙালীর জীবনে বঙ্গবন্ধু একবারই এসেছেন। তিনি সকল তর্ক-বিতর্কের উর্দ্ধে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাহসী নেতা, বাবা-মায়ের স্নেহধন্য সন্তান, প্রেমিক স্বামী এবং বন্ধুবৎসল হৃদয়বান পিতা।

বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন হয় না। তাঁকে অন্তরে স্থান দেয়ার জন্য রাজনীতিবিদ হওয়া লাগে না। বঙ্গবন্ধুই জাতির পিতা।

অতিথি লেখক:
হ্যাপী রহমান
সিডনি-অস্ট্রেলিয়া
১৫.০৮.২০১৭ইং