বাংলাদেশের স্মরনকালের ইতিহাসের এক মহাপ্রতারক ফ্রড দ্য গ্রেট শাহেদ গ্রেফতার হয়েছে এটিই এখন সবচেয়ে বড় সত্য। এবং তা স্বস্তির খবর। কারন সে এখন দেশের আইনের হাতে এসেছে। তাকে অন্তত এখন বিচারের সম্মুখিন করা যাবে।
তার বিচার শাস্তি নিয়ে দেশের মানুষের প্রত্যাশা এখন আকাশের মতো বড়। কারন আমাদের দেশের মানুষজনের সিংহভাগ ভালো এবং সংগ্রামী-পরিশ্রমী। অল্পে সন্তুষ্ট। কষ্ট করে হলেও তারা একটি সৎ জীবন যাপন করে।
কেউ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা-প্রতারনা করলে তা তারা মানতে-সহ্য করতে পারেনা। কোন চোর-জোচ্চর-প্রতারককেও তারা পছন্দ করেনা। সেই মানুষদের দেশে এই শাহেদ দেশের মানুষের সঙ্গে ক্ষমার অযোগ্য প্রতারনার অপরাধ করেছে।
করোনা মহামারীতে এমনিতেই এখন দেশের মানুষের জেরবার অবস্থা। জীবন-জীবিকার কোন কিছুরই নিশ্চয়তা তার নেই। কে বেঁচে থাকবে কে মরে যাবে কেউ এখন জানেনা। জীবন বাঁচাতে গিয়ে জীবিকা হারিয়েছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।
দিনরাত্রি তাদের দুঃস্বপ্নের মতো করে কাটছে। আর তাদের তেমন একটি দুরুহ সংকটের সময়ে মহামারীর দূর্যোগে রাষ্ট্রের দূর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে মানুষকে ঠকিয়েছে এই মহাপ্রতারক। মানুষ অবাক হয়ে ভেবেছে এটা কী করে সম্ভব?
করোনা রোগীদের চিকিৎসার নামকরে সে মানুষ-দেশ-রাষ্ট্র সবাইকে ঠকিয়েছে এই মহাঠগ। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যখন দেশের হাসপাতালগুলোয় ঠাই নেই ঠাই নেই অবস্থা, তখন শাহেদকে অনেকে ভেবেছে মহাপুরুষ!
ত্রাহি মধুসূদন অবস্থায় যখন দেশের চামার বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে মানুষের বিপদে পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন সুযোগ নিতে মাঠে নামে এই মহাপ্রতারক! করোনা রোগীদের ফ্রি চিকিৎসার কথা বলে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে সে।
কিন্তু দেশের দূর্বল খুশি খুশি স্বাস্থ্যব্যবস্থা তখন জানতোইনা যে হাসপাতাল মুখোশের আড়ালের মানুষটি এক মহাপ্রতারক! হাসপাতাল মানে তার ধান্ধার হেড কোয়ার্টার! সেখানে করোনা চিকিৎসার কোন অবকাঠামো-ব্যবস্থাই নেই। আছে টর্চার সেল!
সুনিপুন অভিনয়ে দেশের শীর্ষ স্থানীয় সাংবাদিকদেরও সে বোকা বানিয়েছে! মিডিয়ার লোকজনকে ফ্রি চিকিৎসার সুযোগের কথা বলে সে বশ করেছে সাংবাদিক নেতাদেরও! রোগী পাঠানোর অনুরোধ করে হাত করেছে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও!
সরল বোকা রাষ্ট্র বিদেশি কূটনীতিকদের বলেছে তোমরা ওখানে করোনার চিকিৎসা করতে যেও! অতঃপর জানা গেলো শাহেদের হাসপাতালের কোন লাইসেন্সই নেই! এ যেন লাইসেন্সবিহীন অবৈধ অস্ত্রের মতো আরেক মারনাস্ত্র!
বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা দেবার নাম করে রোগী বাগিয়ে নিয়ে উল্টো তাদের গলাকাটা বিল ধরিয়ে দেয়া হতো! টাকায় করোনার দেয়া হতো ভূয়া পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট! টাকা না দিলে করতো টর্চার!
ভূয়া নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে রোগী ভর্তি করে গলা কাটতো এই মহাপ্রতারক। এভাবে ছয় হাজার ভূয়া করোনা টেস্টের রিপোর্টের নামে কোটি কোটি টাকা বাগানোর প্রমান পেয়েছে র্যাব! করোনা মহামারীর সময়ে এমন ঠগ ধরতে পেরে মানুষতো অবাক!
র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর খুলে যায় প্যান্ডোরা বাক্স। শাহেদের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে পেরে মানুষ অবাক হয়। এরপর তার যে সব পরিচয় বেরুলো তাতে চমকে যায় দেশ! এতো মিডিয়ারও চেনামুখ একজন!
‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ পরিয়ে তাকে টকশোতে সবাই দেখতো! দেশের প্রায় সব টিভি চ্যানেল এই মহাপ্রতারককে টকশোতে নিয়ে গিয়ে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বানিয়েছে! নেপথ্যে এখন দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থারও নাম আসছে!
জানা গেলো শাহেদের নিজের পত্রিকার নামেও আলাদা একটি টকশো চ্যানেল ছিল! সেখানে রাজনীতিক-পুলিশ অফিসার-মিডিয়া ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে নানান লোকজনের টকশোর এঙ্কর সাজতো এই মহাপ্রতারক শাহেদ!
দেশে এখন অনেক মিডিয়ার এমন নিজস্ব চ্যানেল আছে! এই করোনায় ফেসবুক-অনলাইনেও এমন অজস্র টকশোর সয়লাব ঘটেছে। কিন্তু রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযানের পর জানা দেখা গেল রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তার ছবি আছে!
ঈদ বা বিশেষ অনুষ্ঠানের সুযোগে বঙ্গভবন-গণভবনে গিয়ে সে এসব ছবি তুলেছে আর এসব দেখিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারনা করেছে! আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান, আইজিপি সহ কার সঙ্গে তার ছবি নেই!
দেশের জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি তুলে এসব ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে দেশের প্রভাবশালী সবার সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারনা করেছে এই মহাপ্রতারক! এখন জানা যাচ্ছে মহাপ্রতারক হিসাবে সে আগেই ছিল তালিকাভূক্ত!
সেখানে তার নাম শাহেদ করিম। আর সে নাম পাল্টে মোঃ শাহেদ হিসাবে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপকমিটির ২৪ নাম্বার সদস্য! এই কমিটির সদস্য সচিব শাম্মী আখতার বলেছেন তাকে কমিটির সভায় আনতেন জমির উদ্দিন!
যিনি এই কমিটির প্রধান! এই কমিটির চাইতে বিপদজ্জনক হলো এমন এক মহাপ্রতারকের বঙ্গভবন-গণভবনেও ঢুকে যেতে পারা! যেখানে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা জানেন এসব জায়গায় যেতে পারাটা তাদের সারাজীবনের স্বপ্নের বিষয়!
এই শাহেদের মুখোশ খসে পড়ার পর জানা গেল সঞ্চয় প্রকল্প, রিকশা গ্যারেজ, বালু-পাথর থেকে শুরু করে হেন সেক্টর নেই যেখানে তার প্রতারনার হাত পড়েনি! এখন এই প্রতারকের মুখোশ উন্মোচনের কৃতি্ত্ব র্যাব পাবে।
বুধবার সকাল থেকে দেশে বিদেশের বাংলাদেশিদের মধ্যে তাই শুধু র্যাবের জয়গান। কিন্তু একই সঙ্গে র্যাবের কিছু ভূমিকা যে এসব অপরাধীর বিচারের মামলার ভিত্তিকে দূর্বল করে দেয় তা কী তাদের কেউ কখনো ভেবে দেখতে বলে?
এ নিয়ে মাঝে মাঝে আমি কিছু প্রশ্ন রেখে অনেকের অপ্রিয়ও হই। খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশে র্যাব নামের এই এলিট ফোর্সটি গড়া হয়েছিল। এমন এলিট ফোর্স বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। ভারতেও আছে ঠিক এই পোশাক গেটাপের ফোর্স।
তখন র্যাব গঠনে খালেদা জিয়ার বিশেষ একটি নিয়ত ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মারা অথবা দৌড়ের ওপর রাখা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে র্যাবের হাতে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগারই বেশি।
এরজন্যে তাদের ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, অস্ত্র উদ্ধার নামের কিছু টার্ম আছে। এখনকার আওয়ামী লীগ আবার এ ব্যাপারে র্যাবকে যে ব্ল্যাংকচেক দিয়ে রেখেছে তাহলো সন্ত্রাসী মারতে দলীয় পরিচয় দেখার দরকার নেই।
র্যাবের কার্যক্রমের নানান প্রশংসার পাশাপাশি একটা বিষয় নিয়ে আমি শুধু আমার আপত্তি-প্রতিবাদ লিখে রেখে যাই। তাহলো খালেদা জিয়ার বানানো এই বাহিনী জন্মের পর থেকেই কিছু বানানো গল্প বলে। এর কোন দরকার আছে কি?
ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, অস্ত্র উদ্ধারের বানানো গল্পগুলো কেউ বিশ্বাস করেনা। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের সঙ্গে মিথ্যা বলে তাহলে দেশের মানুষ কার ওপর আস্থা রাখবে? আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে সম্পর্ক হবে, কিন্তু তা অবশ্যই সত্যের ভিত্তিতে হবে।
মিথ্যার ওপর কোন সম্পর্ক দাঁড়ায়না। মিথ্যার ওপর কোন সম্পর্ক টেকেনা। তা আপনি যত বড় মহাপুরুষ বা মহাজ্ঞানী হোননা কেনো। অতএব প্লিজ কোথাও কেউ মিথ্যা বলবেননা। দেশের মানুষের সঙ্গেতো নয়ই।
আপনারা এই সরকারের লোকজন অনেক ভালো কাজ করছেন। এই করোনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুলিশ, র্যাব সহ সব বাহিনী চমৎকার কাজ করছে। কতিপয় মিথ্যা দিয়ে এসব কোন অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেননা প্লিজ।
ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, অস্ত্র উদ্ধারে যে গল্প বলা হয় তা মানলেতো বলতে হয় বাংলাদেশ একটি বিপদজ্জনক জংলী রাষ্ট্র! যেখানে এমন কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী আছে যারা এক কথায় দেশের জন্য বিপদজ্জনক!
এরা যখন তখন পুলিশ-র্যাবের সঙ্গেও সশস্ত্র যুদ্ধের সাহস-সামর্থ্য রাখে! আসলেতো বাংলাদেশ তা নয়। শাহেদকে ধরার পর বলা হলো সে নয় দিন ধরে কক্সবাজার থেকে শুরু করে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে!
কিন্তু একটা প্রতারক ধরতে বাংলাদেশের সব বাহিনীর যদি নয় দিন সময় লাগে তাহলে এ জাতির নিরাপত্তা কোথায়? অথচ কত বিপজ্জনক জঙ্গী ধরারও নানান টুলস এখন বাংলাদেশের নানাবাহিনীর হাতে আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলও।
কিন্তু এক প্রতারক ধরা নিয়ে গল্প বলতে হবে কেনো? তার গায়ে কাপড়ে কাদামাখা, জুতো জুড়ো কিন্তু ফকফকা! ডানহাতি শাহেদের বাম কোমরে রাখা একটি জং ধরা পুরনো অস্ত্র! এমন নানাকিছু বিচারের সময় শাহেদের মতো প্রতারকদেরও অস্ত্র হয়!
সাতক্ষীরা সীমান্তের ওপারে বশিরহাট নামের একটি এলাকা আছে। সেখানেই শাহেদের পূর্ব পুরুষের বাড়ি। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ার পর ১১ জুলাই বাংলাদেশকে তা জানানো হয়। ভারত সরকারের সঙ্গে এখন বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক।
সাম্প্রতিক কিছু কারনে তারা সে সম্পর্ক তারা আরও উন্নত করতে চায়। আমাদের এমন একটা মোষ্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিকে ধরে ফেরত দেবার বিষয়টি অফিসিয়েলি জানালে কী মহাভারত অশুদ্ধ হতো? উল্টো এতেতো তারা খুশিই হয়।
মহা প্রতারক শাহেদকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে ঢাকা আনার পর ঢাকায় র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্নটি করেছিলেন। র্যাবের পক্ষে সেখানে কিন্তু এর অসত্য উত্তর দেয়া হয়নি।
বলা হয়েছে পালিয়ে যাবার পর থেকে র্যাব শাহেদকে খুঁজছিল। যে জায়গায় তার অবস্থান শনাক্ত করা গেছে সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাহেদের মতো ফ্রডের মুখোশ উন্মোচনের জন্যে র্যাব সদস্যদের কৃতজ্ঞতা জানাই।