স্বপ্নের রাজাকারের তালিকা! রাজাকারের তালিকা আবার কারও স্বপ্নের তালিকা হয় কী করে? হ্যাঁ, ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্যে এটি স্বপ্নের। কারন আমি যখন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমন করি তখন এ ধরনের একটি তালিকা সংগ্রহ করেছিলাম। সাপ্তাহিক বিচিন্তায় তালিকাটি প্রকাশ শুরু হয়েছিল। এরশাদ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়ায় সেই তালিকা প্রকাশও বন্ধ হয়ে যায়। এই তালিকা সংগ্রহের সময়ই আমার মনে হতো এ ব্যাপারে একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার। স্বাধীনতার উনপঞ্চাশ বছরের পর হলেও উদ্যোগটি নেবার জন্যে শেখ হাসিনার সরকারকে কৃতজ্ঞতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো এই তালিকা প্রকাশের বিষয়ও শেখ হাসিনার সরকারের কীর্তি হয়ে থাকবে। এই তালিকা প্রকাশ যেমন সাহসী উদ্যোগ তেমনি এ নিয়ে বিতর্কও ছড়াতে পারে। কারন আজকের আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক নেতার বাবা-চাচা বা পরিবারের সদস্যদের নাম আসতে পারে তালিকায়। টাকা দিয়ে-নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠানোর অনেক অভিযোগ আছে। এখন টাকা দিয়ে-নিয়ে রাজাকারের তালিকা থেকে নাম পাঠানোর ঘটনা ঘটতে পারে। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায় ব গেছে। কিন্তু ভূয়া রাজাকার পাওয়া যাবেনা। মোটকথা রাজাকারের তালিকা নিয়ে নানান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হতে পারে। প্রিয় প্রজন্মের সাংবাদিকরা তৈরি হও। শুরু করো অনুসন্ধান। এ কাজে আমার সহযোগিতা থাকবে।
এখন দেখা যাক আমি কিভাবে রাজাকারের তালিকা সংগ্রহ করতাম। আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় যে পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম সে পথে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে খুঁজে তাদের ইন্টারভ্যু করতাম। তাদের কাছে প্রশ্নগুলো ছিল এ রকমঃ ১। একাত্তরে তাঁর বয়স, একাত্তরে তিনি কী করতেন, ২। একাত্তরে তাঁর এলাকার আন্দোলন সংগ্রামের বর্ননা। যে এলাকায় কলেজ ছিলো সেখানে নেতৃত্ব ছিল ছাত্রনেতাদের হাতে। যে এলাকায় কলেজ ছিলোনা, ওই এলাকাগুলোর স্কুলের নবম-দশম শ্রেনীর ছাত্ররা, এমনকি শিক্ষকরাও নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। ৩। কে তাঁর এলাকায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা তোলেন, ৪। স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ প্রস্তুতি, অস্ত্র প্রশিক্ষন কিভাবে শুরু হয়েছিল। ৫। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এলাকায় চলে গেলে কিভাবে নিরাপদস্থানে চলে যান। ৬। ভারতে গিয়ে থাকলে কিভাবে যান, কিভাবে মুক্তবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত হন, প্রশিক্ষনের স্মৃতি, ৭। কিছু যুদ্ধের বর্ণনা, ৮। কিভাবে ফিরে আসেন বাংলাদেশে, এসে কী করলেন, এখন কী করেন, ৮। এলাকার শহীদ-মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ৯। এলাকার রাজাকারদের তালিকা, ১০। আজকের বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর বক্তব্য।
আমার বাংলাদেশ ভ্রমনে ১৮ মাস সময় লেগেছিল। দশম প্রশ্ন অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা হাউমাউ করে কাঁদতেন। অসহায়ভাবে বলতেন যে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা দেশ স্বাধীন হবার পর পালিয়ে বেড়িয়েছে তারাই এখন দাপটের সঙ্গে আছে। জিয়া-এরশাদ তাদের নিয়ে দলগঠন করেছেন। তাদের উপজেলা চেয়ারম্যান-জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রী করে পুনর্বাসন করেছেন রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের। একজন খুন হলে খুনির বিচার হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিরিশ লক্ষ মানুষ খুনের সঙ্গে জড়িতদের কেনো বিচার হবেনা তা নিয়ে তারা প্রশ্ন রাখেন। আমি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনটি আমার মতো করে একা একা শুরু করেছিলাম সেটি মূলত মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ পরিবারের কাছে কথা দিয়েছিলাম বলেই। আওয়ামী লীগ বা মূলধারার দলগুলো এ কাজটিতে জড়ায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তালিকাটির প্রথম পর্ব প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, তারা কোন তালিকা প্রণয়ন করেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যে তালিকা ছিল তা তারা প্রকাশ করেছেন। রাজাকারদের তখন মাসে দেড়শ টাকা ভাতা দেয়া হতো। ভাতা আর যাদের অস্ত্র দেয়া হয়েছে তাদের তালিকা ধরে প্রথম পর্বের তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রীর বক্তব্যেই তালিকার দূর্বলতা অসম্পূর্নতা আছে। শান্তি কমিটির সদস্য সহ এলিট রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের এই তালিকায় পাওয়া যাবেনা। কারন তারাতো দেড়শ টাকা ভাতা নেবার মতো দুস্থ ব্যক্তি ছিলেননা। মূলত মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, কনভেনশন মুসলিম লীগের সদস্যরা এলাকায় এলাকায় শান্তি কমিটি গঠন করে পাকিস্তানি জেনারেলদের পক্ষে কাজ করেন। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘের ভূমিকাটি ছিল সবচেয়ে সংঘবদ্ধ। আমাকে অনেক সময় অনেকে জিজ্ঞেস করেন অমুক রাজাকার কিনা। তখন জবাব দিয়ে বলি একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকার ফাইল দেখো। বনেদি রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের নাম ছাপা হতো সংগ্রাম পত্রিকায়। যার তার নাম সংগ্রাম পত্রিকায় ছাপা হতোনা। মানে ভালো রাজাকার হিসাবে তারা তাকে স্বীকৃতিই দিতো। আলবদর, আল শামস এসব কিলার বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি। এরাই বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে।
একাত্তরের সংগ্রাম পত্রিকার ফাইলে দেলোয়ার হোসেন সাঈদির নাম নেই। কারন সাঈদি তখন জামায়াত করতোনা। বড় রাজাকারও ছিলোনা। সাঈদির নাম পত্রিকায় আসার একটি ইতিহাস আছে। বিচিন্তায় রাজাকারের তালিকা ছাপা হচ্ছে দেখে পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড তাদের প্যাডে আমাদেরকে একটা চিঠি লিখে। সেখানে তারা লিখে একাত্তরে পিরোজপুরের পাড়েরহাট এলাকায় দেইলা রাজাকার নামের এক নৃশংস স্বভাবের রাজাকার ছিল। যে লুটের মালও হাটবারে পাড়েরহাট বাজারে বিক্রি করতো। সাঈদখালী গ্রামে ছিল তার বাড়ি। দেশ স্বাধীন হবার পর পালিয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরতে পারেনি। এখন দেখা যাচ্ছে ওই লোকটি নাম পাল্টে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদি নামে বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ করে বেড়াচ্ছে। ওই চিঠি পেয়ে আমি সাঈদির ইন্টারভ্যু নেবার চেষ্টা করি। তিনি আমাকে একটি সময়ও দেন। কিন্তু ইন্টারভ্যু নিতে নির্ধারিত সময়ে বাসায় গিয়ে শুনি তিনি আগের দিন বিদেশে চলে গেছেন।
এভাবে সাঈদি কোনদিন আমাকে ইন্টারভ্যু দেননি। বিভিন্নভাবে এড়িয়ে গেছেন। তার আমেরিকা-বিলাত যাওয়া কিভাবে বন্ধ হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে সে রিপোর্টও আমাকে প্রথম করতে হয়েছে। একাত্তরের দেলোয়ার হোসেন, দেইলা’ তার নামের সঙ্গে ‘সাঈদি’, ‘আল্লামা’ এসব এফিডেবিট ছাড়া নিজে নিজেই লাগিয়েছেন। গ্রামের সাঈদখালী নাম থেকে সাঈদি’র সংযুক্তি। যেমন ফুলতলী, এনায়েতপুরী’ এসব টাইটেল এসেছে। নামডাক হবার পর তিনি মাওলানা রহিমের সঙ্গে ইসলামিক ডেমোক্রেডিক লীগ করতেন। সেখান থেকে জামায়াত তাকে হায়ার করে।
রাজাকারের পূর্নাঙ্গ তালিকা নিয়ে যে গোলমাল হবে তা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর বক্তব্যেই আছে। বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতায় এসে জামায়াত সরকারি দফতর থেকে অনেক তালিকা সরিয়েছে। কাজেই জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্টারভ্যু করে তারা বেঁচে থাকতে থাকতে তালিকাটি সম্পূর্ন করতে হবে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে গেছেন, কিন্তু দেশে তাদের বাবা-চাচা ছিলেন রাজাকার, এমন ঘটনা বিস্তর আছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপা নেতাদের আত্মীয়স্বজন অনেকেও রাজাকার ছিলেন। সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান সম্ভবত দেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর রাজাকার পিতার মৃত্যুর পর জানাজার নামাজের আগে তাঁর পিতার একাত্তরের অপরাধের জন্যে উপস্থিত জনতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
আবার রাজাকারদের ধৃষ্ট আচরনের একটা ঘটনা বলি। ভোলায় মোখলেসুর রহমান নামের এক রাজাকারের ইন্টারভ্যু করেছিলাম। আমাকে তিনি বলেন, যেমন দেখি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢুকে গেছে তখন জান বাঁচাতে আমার ভাগ্নে এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা, তার বাড়িতে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতো আরও অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। আমার ভাগ্নে আমাকে বলেন, মামারে আপনাদের পেলে পাবলিক এখন পিটিয়ে মেরে ফেলবে। এরচেয়ে ভালো আপনাদের থানার মাধ্যমে জেলখানায় রেখে আসি। সেখানে অন্তত নিরাপদ থাকবেন। ভাগ্নে আমাদের জন্যে তাই করলেন। এরপর জেলখানায় থাকছি, খাইছি, আল্লারে ডাকছি। এরপর একদিন শেখ সাব মাফ করে দিলেন। বাইর হইয়া আইলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, এই যে শেখ সাহেব আপনাদের মাফ করে দিলেন এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী? কোন কৃতজ্ঞতাবোধ হয় তাঁর জন্যে? রাজাকার মোখলেসুর রহমান তখন পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে বলে, শেখের ব্যাটা ছাড়বেনা মানে। আমাদের গায়ে হাত দেয় এমন শক্তি তার ছিলো নাকি।‘ এই হলো খাঁটি রাজাকার চরিত্র।
কাজেই নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের সাবধান থাকতে হবে কোন প্রভাব বা টাকার বিনিময়ে যাতে কোন রাজাকারের নাম তালিকা থেকে বাদ না পড়ে। সিলেটি ভাষায় বলি, ‘রাজাকারোর তালিকা লইয়া তাইলে রেবা ব্যাঙ্গা লাগবো’। একজন রাজাকারের নামও যাতে এই তালিকা থেকে বাদ না পড়ে।