চট্টগ্রামের রাউজানের ডাবুয়া গ্রামের একজন শ্রমজীবী টাইপিস্ট ফয়েজ চৌধুরীর মেয়ে আফরোজা সুলতানা রত্মা। ১৯৫২ সালের ১৫ জুন জন্ম। পড়াশুনার চাইতে সিনেমায় আগ্রহী এক মেয়ে। কারন চাচা সিনেমার বিখ্যাত পরিচালক এহতেশাম।
রত্মার বাবা ফয়েজ চৌধুরীর খালাতো ভাই এই এহতেশাম। একদিন তিনি ফয়েজ চৌধুরীকে বলেন রত্মাকে দিয়ে তিনি একটা ছবিতে কাজ করাতে চান। ফয়েজ চৌধুরী তাঁকে বলেন, ও কী করে সিনেমায় কাজ করবে।
সেতো এমনই লাজুক যে কারও সামনেই বেরোয়না। এহতেশাম বলেন, এমন একটা লাজুক মেয়েই তিনি খুঁজছেন। অতএব ৮ বছর বয়সেই এহতেশামের ‘নতুন সুর’ ছবির মাধ্যমে তার সিনেমা জীবন শুরু।
এবং সেখানেই তার পড়াশুনার জীবন শেষ। ‘নতুন সুর’এ মিষ্টি মেয়ে রত্মার কাজ দেখে চিত্র পরিচালক ইবনে মিজানের চোখে পড়ে শিশু মেয়েটি। ইবনে মিজান তাঁর ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে কাজ করান রত্মাকে দিয়ে।
এই দুই ছবিতে রত্মার কাজ দেখে পরিচালক মুস্তাফিজ তাঁর ‘ডাকবাবু’ ছবির পার্শ্বচরিত্রে মেয়েটিকে দিয়ে কাজ করান। এভাবে জহুরি পরিচালক এহতেশামের নতুন নায়িকার গ্রাউন্ডওয়ার্কের কাজটি এগোয়।
এহতেশাম ভাবলেন এই রত্মাফত্মা নাম দিয়ে নতুন নায়িকা সিনেমায় চলবেনা। এর আগে ঝর্না বসাকের জন্যে সিনেমার নাম করা হয়েছিল শবনম। এবার রত্মার জন্যে নাম ঠিক করা হয় শাবানা।
শবনমের মতো শাবানা নামটিও দর্শকরা গ্রহন করেছে। সেই থেকে এহতেশামেরও নাম হয়ে যায় জহুরি। শাবনাজ, শাবনুর নাম পর্যন্ত চলেছে জহুরি দুনিয়া। এহতেশাম তার ভাইজি রত্মাকে শাবানা নামে নায়িকা হিসাবে ব্রেক দেন ১৯৬৭ সালে চকোরী ছবিতে।
নায়ক নাদিমের বিপরীতে সেই প্রথম ছবিতেই নায়িকা শাবানাকে দর্শকরা বিপুল অভ্যর্থনা জানান। সেই নায়িকা শাবানাকেও আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর থেকেই বাংলা-উর্দু মিলিয়ে একটার পর একটা ছবি মুক্তি পেতে থাকে শাবানার।
সেই ষাটের দশক থেকে নব্বুইর দশক পর্যন্ত ঢাকার সিনেমার জগতকে এক রকম শাসন করেছেন এই নায়িকা। শহুরে বা গ্রামীন চরিত্রে অথবা রূপকথার নায়িকা, সব চরিত্রেই শাবানাকে দর্শকরা গ্রহন করেন।
অতিথি’ ছবির ‘ও পাখি তোর যন্ত্রনা আরতো প্রানে সয়না’ গেয়ে গেয়ে পাখি তাড়ানো, অথবা ‘বানজারান’ ছবির ‘ওরে ও পরদশী’ গাওয়া জিপসি মেয়ে উভয় চরিত্রেই শাবানা ছিলেন অনবদ্য।
সিনেমায় পুঁজি লগ্নিকরা প্রযোজকরাও দেখেন শাবানা মানেই পয়মন্ত এক নায়িকা। তাঁর ক্যারিয়ারে ফ্লপ ছবি খুব একটা পাওয়া যাবেনা। শাবানা নামের একটি মানেও তখন লেখা হতো, ‘শান্ত বাঙালি নারী’।
১৯৭৩ সালে শাবানা বিয়ে করেন সরকারি কর্মকর্তা এস এম সাদেককে। ৩৬ বছরের ক্যারিয়ারে অভিনয় করেন প্রায় তিনশ ছবিতে। স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের কারনে সিনেমার বিজ্ঞাপনে তাঁর উপমা হয়ে ওঠে বিউটি কুইন।
তখন নায়িকাদের শুটিং এ আসা যাওয়ায় অভিভাবক চরিত্রটিও ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। বিয়ের আগেপরে দীর্ঘদিন তাঁর বাবা তাঁকে শুটিং এর সেটে আনা নেয়া করেছেন।
মেয়ের চলচ্চিত্র সাফল্যের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পিতা ফয়েজ চৌধুরীরও তখন পৃথক নিজস্ব একটি ফিল্মি ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে। পরিচালক ফয়েজ চৌধুরী পরিচালিত ‘মুক্তি’ ও ‘মালকাবানু’ নামের দুটি ছবি মুক্তি পায়।
এরমাঝে শাবানা-জাভেদ অভিনীত ‘মালকাবানু’ ছবিটি সেই সময়ের সুপার ডুপার হিট ছবি। মালকাবানুর গানগুলো তখন পথেঘাটে গাওয়া হতো। রূপবান ছবিটির পর সম্ভবত এই ‘মালকাবানু’ তেমন উল্লেখ করার মতো একটি ছবি।
রূপবানের পর মালকাবানু’ ছবিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সিনেমাহলগুলোতে টানা বছরকাল ধরে চলেছে। দুটিই লোক কাহিনী ভিত্তিক ছবি। এই দুটি ছবির বিপুল সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সিনেমা দর্শকদের মানসপটও সংশ্লিষ্ট।
এক সময় ঢাকাই ছবির চিত্র পরিচালক কাজী জহিরের ছবি মানেই তখন পারিবারিক গল্পের স্নিগ্ধ মেজাজের বানিজ্যিক সফল ছবি। নিজের পাঁচ অক্ষরের মতো তাঁর সব ছবির নামও পাঁচ অক্ষরে।
১৯৭০ সালে কাজী জহিরের ‘মধু মিলন’, ১৯৭২ সালে ‘অবুঝ মন’ ছবির নায়িকা হন শাবানা। এই দুই ছবির মাধ্যমে তখন রাজ্জাক-শাবানা জুটিটিও গড়ে ওঠে। উজ্জ্বল, জাফর ইকবালের সঙ্গেও শাবানা তখন ছবি করেন।
মোস্তাফিজের ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, কাজী মেসবাহ উদ্দিনের ‘ছদ্মবেশী’, এসএম শফীর ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’, নাজমুল হুদার ‘চৌধুরী বাড়ি’ সহ নানান ছবি তাঁকে তরতর খ্যাতির চূড়ার পথে নিয়ে যেতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের পর শাবানা অভিনীত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’ বিশেষ আলোচিত হয়। প্রযোজক মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ পারভেজ, মুক্তিযোদ্ধা চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ছবিটায় সেই সময়ের আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা খসরুও অভিনয় করেন।
নীহার রঞ্জন গুপ্ত’র কাহিনী অবলম্বনে ‘ঝড়ের পাখি’ ছবিটির কথা মনে পড়ে? সেই যে ছদ্মবেশ নেয়া রাজ্জাকের মুখে গান, ‘আমি এক নীড় হারা ঝড়ের পাখি’। ওই ছবির নায়িকাও ছিলেন শাবানা।
ঢাকার ছবির নায়কদের মধ্যে ছবি প্রযোজনাতেও তিনি সবচেয়ে সফল। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস এস প্রডাকশন্স ‘মাটির ঘর’, ‘সখী তুমি কার’ সহ অনেকগুলো সফল ছবি উপহার দিয়েছে।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘নাজমা’, ‘ভাত দে’ ছবির মাধ্যমে টানা তিন বছর শ্রেষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাবানা। মোট দশবার তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ দেশের মোটামুটি সব পুরস্কারই তাঁর উঠেছে। ২০১৭ সালে তাঁর হাতে আজীবন সম্মাননার পুরস্কার হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন দেশে এলে শাবানা প্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন।
আর তখনই শোনা যায় তিনি শশুরবাড়ির আসন যশোরের কেশবপুর থেকে নির্বাচন করতে চান। এর আগে শেখ হাসিনার কারনে কবরী মনোনয়ন পেয়ে নারায়নগঞ্জ থেকে এমপি হয়েছেন। এরজন্যে শাবানার আগ্রহ নিয়েও নিউজ হয়।
রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, বুলবুল আহমদ, জসিম সহ ঢাকার ছবির প্রায় সব নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন শাবানা। এরমাঝে শুধু আলমগীরের বিপরীতেই তিনি ১৩০ টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন।
১৯৯৭ সালে হঠাৎ করেই অভিনয় জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আমেরিকা চলে যান শাবানা। বিদেশে পড়াশুনায় থাকা তাঁর এক মেয়ের কোন কারনে নিখোঁজ হবার ঘটনা থেকে একজন মা হিসাবে তা ভেঙ্গে পড়ার খবর তখন মিডিয়ায় এসেছে।
শাবানা-সাদিক দম্পতির দুই মেয়ে এক ছেলে পড়াশুনা উপলক্ষে আমেরিকায় গিয়ে সেখানেই তারা থিতু হয়েছেন। সেই থেকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিউজার্সিতেই থাকেন দেশের চলচ্চিত্রের সাবেক এই বিউটি কুইন।
সাবেক নায়িকার বেশভূষাও এখন পরিবর্তিত। বাংলাদেশের সিনেমা জগতের স্বর্নযুগের তারকাদের অন্যতম এই শাবানা। কবরী, ববিতা, শাবানাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে চলচ্চিত্রে তাঁদের যথাযথ প্রতিস্থাপন আর হয়নি।
অথবা সে মানের মাপের শিল্পীদেরও আর পায়নি ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। শাবানাদের বিকল্পও যে আর হবার নয় তাও এই সময়ে আরও বেশি প্রকাশিত। মানুষের মনের মন্দিরে অবস্থান যার সেই শাবানা ভালো থাকবেন চিরকাল।