দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর নুসরাত হত্যার বিচার নিম্ন আদালতে শেষ হয়েছে অবিশ্বাস্য কম সময়ে। বিচারের রায় ঘোষনার পর আসামি পক্ষ ছাড়া সকল পক্ষের সমস্বর উচ্চারন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরদারির কারনে এই বিচার এভাবে নজিরবিহীন কম সময়ে শেষ হতে পেরেছে। এই ঘোষনাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যে একটি উজ্জ্বল স্বীকৃতি। কিন্তু দেশের জন্যে অন্ধকারের হাতছানি। চাঞ্চল্যকর-অচাঞ্চল্যকর নানান হত্যাকান্ড দেশে প্রতিদিন ঘটছে। প্রতিটি ঘটনা পরিবারগুলোর জন্যে কান্নার। বেদনার। অনেক পরিবারগুলোকে ধংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সব ঘটনার নজরদারি প্রধানমন্ত্রী করতে পারেননা সেগুলোর কী দ্রুত বিচার হবেনা? প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেতো সব ঘটনার নজরদারি সম্ভবও নয়। আবার নারায়নগঞ্জের ত্বকী, কুমিল্লার তনু হত্যার বিচার পরিস্থিতির কথা প্রধানমন্ত্রী জানেন না এটা ভাবারও কোন কারন নেই। এটা দেশের জন্যে, তাঁর শাসন সময়ের জন্যে বিব্রতকর।
নুসরাতের ঘটনার খবরে দেশ যখন বিচলিত, বিক্ষুদ্ধ, কাঁদছিল তখন ঘটনাস্থল সোনাগাজীতে একটি অস্বাভাবিক মানববন্ধন, মিছিলের ছবি মনে করতে পারেন। একদল যুবক ঘটনাটিকে মিথ্যা, সাজানো, মাদ্রাসা শিক্ষক সিরাজের ভাবমূর্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র দাবি করে ওই মহড়া দেয়! এবং জানা যায় এই জঘন্য মহড়ার নেপথ্যের ক্রীড়নক স্থানীয় আওয়ামী লীগ! কারন সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হত্যার আয়োজনে জড়িত ছিলেন। আর আওয়ামী লীগের অসৎ নেতাদের নেতার নাম নিজাম হাজারী। এরজন্যে ফেনীর পুলিশ সুপার, সোনাগাজীর থানার ওসি দু’জনেই শুরু থেকে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন! সমকাল সহ আরও কয়েকটি পত্রিকায় প্রথমে আত্মহত্যা বলে রিপোর্টও হয়। এরপর মরন্মুখ নুসরাত যখন পৌঁছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারী ও বার্ন ইউনিটে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চিকিৎসার দায়িত্ব নেন মেয়েটির তখন এসপি-ওসি-স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ বোল পাল্টাতে শুরু করে।
নুসরাতের মায়ের মামলার পর ওসি মোয়াজ্জেম যখন মেয়েটিকে তার অফিসে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আরেকদফা যৌন নিগ্রহ করেন, এর ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পরও ওসিকে গ্রেফতার করতে অনেক দিন লেগেছে! কারন ওসি আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার আত্মীয়! তাকে বাঁচাতে আদালতে তার পক্ষ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ আইনজীবী নেতা! দেশের অবস্থা এখন অনেকটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবেন একভাবে, তাঁর দল এক্ট করে আরেক ভাবে! এমনসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এই হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়েছে। সবশেষে হত্যা মামলার রায় ঘোষনার পর দেখা গেলো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এক নারী আসামীর কোলে তার নবজাত দুগ্ধপোষ্য শিশু। মানে হত্যাকান্ড ঘটানোর সময় মেয়েটি অন্তঃস্বত্ত্বা ছিল! ওই অবস্থায় সে তার সহপাঠিনীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জঘন্য যজ্ঞে অংশ নিয়েছে! এখন সবাই তার জন্যে তার শিশুটির জন্যে ভাবছে কিন্তু সে যখন কাজটি করে তখন এ নিয়ে একদম ভাবেনি! নুসরাত হত্যাকান্ড দেশের মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরের অন্ধকার দিকটিকেও সামনে নিয়ে এসেছে। দেশের ধর্মভীরু মানুষেরা বড় এক বিশ্বাস আর ভরসায় ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসা শিক্ষায় পাঠান। কিন্তু এখন আর সব মাদ্রাসা যে নিরাপদ না, এ ঘটনা তা সামনে নিয়ে এসেছে। নুসরাত মারা যাবার পর তার জানাজা হয়েছে স্থানীয় হাইস্কুলের মাঠে। তার মাদ্রাসা চত্বরে নয়। একজন ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় সেখানে একটি মিলাদ বা দোয়া মাহফিল আয়োজনের খবরও কেউ শোনেনি! এ কোন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? এদের ধর্মইবা কী!
নুসরাতের ঘটনার পর সোনাগাজীতে এমন একজন ঘৃন্য সিরাজের পক্ষে মানববন্ধন, বক্তৃতাবাজীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন অংশ নিয়েছিল কেনো? কেন বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার ছবি পোষ্টারে হত্যাকান্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতার মুক্তির দাবিতে সভা হয়েছে? এখনও কেনো সেখানে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সেই নেতার মুক্তির দাবিতে তোরন রয়েছে? এসব দেখার কী কেউ নেই এ দলে? আগেই বলেছি, প্রধানমন্ত্রী চান এক রকম, তাঁর দলের লোকজন এক্ট করে আরেক রকম! এরজন্যে প্রধানমন্ত্রীর কতো অর্জন-সাফল্য যে দল হিসাবে আওয়ামী লীগ ক্যাশ করতে পারেনা! স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের গণসম্পৃক্তি বাড়েনা! একটা দল ধারাবাহিকভাবে এতোদিন ধরে ক্ষমতায়, এই দলটার দেশজুড়ে এত লোকজন! কিন্তু বাস্তবে এদের বেশিরভাগ যেন প্রধানমন্ত্রীর ভাষার, ‘মুই কেনু হনুরে’! এই দলটার নাম যে আওয়ামী লীগ, এর নেতা যে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা, এ দলটার কি নীতি-আদর্শ তা দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী জানেননা অথবা ধারন করেননা। একটা দল ধারাবাহিকভাবে এতদিন ধরে ক্ষমতায় কিন্তু একেকটি ঘটনার পর একপক্ষ দলের ভিতর বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীর রা’ তোলেন! অথচ কখন কোন লোকটি কিভাবে কার হাতে ফুল দিয়ে ঢুকেছে এসবেরতো ছবি-ফুটেজও আছে। এসব নিয়ে যখন কথা উঠেছিল তখন বলেছিলেন, খেলার প্রয়োজনে বাইরে থেকে প্লেয়ার হায়ার করতেও হয়! আর ঘটনা ঘটার পর অনুপ্রবেশকারী বলে চিৎকার-চেঁচামিচি হাস্যকর শোনায়। আপনারা সবাই কী নিধিরাম সর্দার? না ঘুমান সারাক্ষন? না ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন যে অনুপ্রবেশকারীরা সবকিছু ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে? এসব বন্ধ করা দরকার।
আসলে দেশের বাস্তবতা এমন অবস্থায় চলে গিয়েছিল যে কিছু লোক ভাবতে শিখে গিয়েছিল, দলের নামে মিছিল-শ্লোগান করতে দিতে পারলেই সব খুন মাফ! কিন্তু সব পরিস্থিতিতে যে সবকিছু চলেনা দলবাজ ধান্ধাবাজরা তাও বুঝেশুনে চলার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন! নতুবা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেখেশুনেওতো তারা বুঝতে পারেন না কেনো যে দলটা কার, তিনি কী চান। দলবাজ-ধান্ধাবাজদের সাম্প্রতিক এমন আরও অনেক ভুল চিহ্নিত হয়েছে। নইলে শেখ হাসিনা যেখানে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদককে সেক্রিফাইস করতে পারেন তখন ওই ঘটনার পর আবার আবরার হত্যাকারীরা কী করে ওই সাহস পায়? আবরার হত্যাকান্ড দেশের ছাত্রদের মধ্যে-মধ্যবিত্তের মধ্যে সরকারের কী পরিমান ক্ষতি করেছে তা কী কোন জরিপের ব্যবস্থা আছে?
যুবলীগের নেতাদের নাম ধরে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দিয়েছিলেন দলের সভায়। ওই নেতাদের গডফাদার নেতারা তখনও মনে করছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে শান্ত করা যাবে। চেষ্টাও কম চলছিলোনা। কিন্তু ততোক্ষনে একটি অনলাইনকে দিয়ে নিউজ করিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ। এরপর আর কী আর ঘটনা শান্ত হয়? দ্রুত একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। ক্যাসিনো কান্ড জেনেশুনে চমকে যায় দেশ। অথচ এই দলটা কত গর্ব করে বলতো বঙ্গবন্ধু জুয়া নিষিদ্ধ করলেও জিয়া তা আবার চালু করেছিলেন। কিন্তু মানুষ দেখলো যুবলীগ এটাতো শুধু চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি না, ক্যাসিনো জুয়ারও বাপ! এর নেতা ৭১ বছর বয়সী যুবক! কিন্তু এসব ধরাধরির মধ্যেও কিছু বোকা ধান্ধাবাজ বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা আর সম্রাটের ছবি দিয়ে পোস্টার করছে! কোর্ট পাড়ায় মিছিল করছে! সম্রাট বিভিন্ন সময়ে ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী কিভাবে তার বুকে পাড়া দিয়ে কমিটি ভেঙ্গে দেবার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে অত অত পরিমান টাকা নেন! সেই সম্রাট এখন জেলে, ওমর ফারুক বাইরে! ওমর ফারুককে রক্ষার জন্য তার স্ত্রীর ভাই শেখ সেলিম আছেন। খরচের খাতায় ফেলে দেয়া সম্রাটের জন্য কে আছেন? আওয়ামী লীগ করেন আবার বোকার দল হিসাবনিকাশ বোঝেনা কেনো?
আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামী ট্রেন মার্চ রাত দুটোয় ফেনী রেলস্টেশনে পৌঁছলে জয়নাল হাজারীর দাপুটে ক্লাস কমিটির দেয়া গার্ড অব অনার এই প্রজন্ম দেখেনি। তখন হাজারীর কথায় ফেনীর গাছের পাতা নড়ে! ফেনীর সবকিছুই তার দখলে। ওই অবস্থায় তার একচ্ছত্র ঠিকাদারি দুর্নীতির মাধ্যমে নির্মানাধীন ফেনীর ক্রীড়া কমপ্লেক্স ভেঙ্গে পড়ে বেশ ক’জন শ্রমিকের হতাহতের ঘটনার সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম। ওবায়দুল কাদের তখন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা। ঘটনার পর ভোরের দিকে ফেনীতে পৌঁছে যান ওবায়দুল কাদের। আমি আমার সেই রিপোর্ট যতোটা সাবধানে লিখেছি, ওবায়দুল কাদের এর ধার ধারেননি। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে সেই যে হাজারীর কপাল পুড়তে শুরু করে এখন তাকে চিকিৎসার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলের দান গ্রহন করতে হয় আর নিজের প্রচারের জন্যে যেতে হয় ফেসবুক লাইভে! দলবাজ বোকারা এসব দেখেও শেখেনা!
নারায়নগঞ্জের যারা অন্ধের মতো শামীম ওসমান শামীম ওসমান করেন তারা জানেননা এই আইভিকে নিউজিল্যান্ড থেকে ডেকে এনে তখন পৌরসভার চেয়ারম্যান করেছিলেন। এরপর আবার সিটি নির্বাচনে শামীম ওসমানকেই সুযোগ দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ভোটের মাঠের গোয়েন্দা রিপোর্ট হাতে পাবার পর তাঁর মত পাল্টাতেও দেরি হয়নি। আইভির নির্বাচনের আগ মূহুর্তে কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে শেখ হাসিনা ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে। সেখানকার নারী মেয়র প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে শেখ হাসিনা তাকে বলেন, আমরাও খুব শীগগির প্রথমবারের জন্যে একজন নারী মেয়র পেতে যাচ্ছি। ভোটের দিন দুপুরের আগেই উর্ধতন নির্দেশে শামীম ওসমানকে তার বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হয়, খবরদার আপনি আর বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা করবেননা। এরপরও যারা আওয়ামী লীগ করেন আর সব জেনে অথবা তা জেনে শামীম শামীম ডাক পাড়েন তারা বোকা ছাড়া কি?
শামীম ওসমানের বাবা-দাদা নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। শামীম ওসমানদের ফুফু ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের স্ত্রী। খুব মানবিক এক নারী। কখনও প্রকাশ্যে আসেননা। ব্যারিস্টার তানিয়া আমির শামীম ওসমানদের ফুফাতো বোন। আইভির বাবা আলী আহমদ চুনকাও সে যুগের নেতা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতারা ভয়ে দিল্লীতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ করতেননা তখনও তাঁর খোঁজখবর রাখতেন শামীম ওসমানদের বাবা শামসুজ্জোহা। এরজন্য শেখ হাসিনা পরিবারটির ওপর দূর্বল। কিন্তু এই পরিবারটিতো এখন আর সম্পূর্ন স্বত্ত্বায় আওয়ামী লীগকে ধারন করেনা। পরিবারটির অর্ধেক অন্তর আওয়ামী লীগ অর্ধেক জাতীয় পার্টি। এরা এখন আর বঙ্গবন্ধু বা তাদের পূর্বপুরুষদের আওয়ামী লীগকে ধারন করেনা। আর বুদ্ধিমান হলে আওয়ামী লীগ করতে চাইলে শেখ হাসিনারটা করবেন। শামীম ওসমানদেরটা না। আওয়ামী লীগ দলটাকে দিন শেষে নিজস্ব নীতি আদর্শের কাছে যেতে হয়। এ দল প্রয়োজনে বিভিন্ন গুন্ডাকে ব্যবহার করেছে আবার ছুঁড়েও ফেলে দিয়েছে। পঙ্কজ দেবনাথ কি এক সময় এ দলের জন্যে কম করেছে? কিন্তু পঙ্কজ দেবনাথরা দুর্নীতির এমন পর্যায় ছাড়িয়েছে যে তাদের ছুঁড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে। চলতি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরুর পর এ দলের সিনিয়র মাঝারি জুনিয়র এত নেতার ইয়া নফসি ইয়া নফসি শুরুর কারন, শেখ হাসিনার কাছে সবার খবর আছে। এক নুসরাতের ঘটনায় সোনাগাজীর কিছু দূর্বৃত্তের কথা বলতে গিয়ে এত কথা তোলার কারন শুদ্ধিটা সবার নিজের থেকে আসলে ভালো। নইলে যে কোন দূর্বৃত্ত যে কোথাও ধরা পড়বেই। এটিই প্রকৃতির নিয়ম।