করোনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নিজস্ব স্টাইলের যুদ্ধ

বাংলাদেশের করোনা যুদ্ধ নিয়ে নানামুনির নানা মত। নাকউঁচু অনেকের বিরক্তি চরমে! সরকার কিচ্ছু করেনা! কিচ্ছু পারেনা! আমিও মাঝে মাঝে কিছু এলোমেলো মন্তব্য করি। কিন্তু দিন শেষে দেখি ভিন্ন এক দারুন ফাইট দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

প্রথম থেকে একটা কথা লিখছিলাম তাহলো করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে মহামারী হবার উপাদান-সুযোগ কম। কারন যে সব দেশে এটি মহামারী হয়েছে সে দেশগুলোর সমাজ বহুজাতিক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশিদের মৃত্যুও বেশি বিদেশে।

অথচ সে সব দেশের চিকিৎসা-আর্থিক সমস্যা অনেক বেশি উন্নত-সুসংগঠিত। কেনো জানি বাংলাদেশের কিছু মানুষের মধ্যে শুকরিয়া বোধ কম। দেশের নেগেটিভটাই এরা বেশি দেখে। মানুষের সংগ্রামটাকে এরা এপ্রিসিয়েট করতে জানেনা!

ইতালি ফেরত যে প্রবাসীদের মাধ্যমে রোগটি দেশে আসে, যে লোকটি দেশের সিস্টেমকে গালিগালাজ করছিলেন, একদিন তার ফেসবুক আইডিতে গিয়ে চমকে উঠেছি। তিনি আওয়ামী লীগের লোক। এলাকায় দিব্যি ত্রান তৎপরতা চালাচ্ছেন! এরমানে তার সমাজও তাকে গ্রহন করে নিয়েছে! এটিইতো বাংলাদেশ।

গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর, মাদারীপুরের শিবচরে যারা রোগটির পারিবারিক-সামাজিক সংক্রমন ঘটিয়েছিলেন তারাও পরে প্রশাসনকে সহায়তা করায় সে এলাকাগুলোর সংক্রমন আর বাড়েনি।

নারায়নগঞ্জের প্রথম সংক্রমন আসে উমরাহ হজ থেকে। মিরপুরের টোলারবাগে আক্রান্ত হন নিরীহ মুসল্লি। নারায়নগঞ্জের মেয়র আইভি নিজে একজন ডাক্তার। তাঁর এলাকার সমস্যা বুঝে কার্ফু চাচ্ছিলেন। কিন্তু ডিসি সাহেব যেন মনে করলেন কার্ফু দিলে বুঝি তার চাকুরি নথিতে দাগ পড়ে যাবে!

 আমলাতন্ত্র তার কথা শুনে ভুল করলো। নারায়নগঞ্জের করোনা মূলত ছড়িয়ে গেলো সবখানে! এসব নিয়ে এখন আর ঘাটাঘাটিতে সময় নষ্ট না করে বাংলাদেশের যুদ্ধটাকে সমর্থন করতে হবে। অবিরাম থেমে থাকার দেশ বাংলাদেশ নয়।

আমরা যেভাবে ফেরি ভর্তি মানুষের ভীতিকর যাতায়াত দেখেছি, অন্য অনেক দেশ হলে এতোক্ষনে পথেঘাটে লাশ আর লাশ দেখতেন। কেনো হয়নি জানেন? এমনওতো হতে পরে বাংলাদেশের মানুষ সারা বছর যা খেয়ে-যতকিছু সামাল দিয়ে লড়াকু টিকে আছেন, এ জাতিইতো এক ধরনের এন্টিবডি জাতি!

 মদ কেনার কাড়াকাড়ি নিয়ে ভারতে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের সে সমস্যা নেই।

একজন গার্মেন্টস মালিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমাকে বললেন আপনারাতো শুধু আমাদের গালিগালাজ করলেন, কিন্তু আমাদের এই সৈনিকগুলোর যুদ্ধ দেখলেননা! তাঁর কথা এসব গার্মেন্টস শ্রমিক যদি নিজের আগ্রহে এভাবে কাজ না করতো তাদের কেউ জোর করে কাজ করাতে পারতোনা।

এই গার্মেন্টস শ্রমিকদের সিংহভাগ বয়সে তরুন। বেশিরভাগ কারখানায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকায় অন্য অনেক সেক্টরের চেয়ে এখানকার শ্রমিকরা তুলনামূলক স্বাস্থ্য সচেতন।

এরা যখন প্রথম কাজে আসে তখন তাদের বলা হতো এখানে অনেক পরিশ্রম, হয়তো তোমাদের জন্ডিসও হবে। কিন্তু প্রথম তিন মাস যারা সামাল দিয়ে ফেলবে তারা এখানে ভালো থাকবে।

গার্মেন্টস সেক্টরের মেয়ে শ্রমিকদের বেশিরভাগ বিয়ের পর আর কাজ করেনা। ছেলে শ্রমিদের অনেকে বছর কয়েক পর অন্য পেশায় চলে যায়। মোটামুটি যতোক্ষন ভালো পরিশ্রম করতে পারে ততোক্ষনই সিংহভাগ এখানে থাকে। এই ফাইটারদের খুব কমসংখ্যককে এখন পর্যন্ত কাবু করতে পেরেছে করোনা।

গার্মেন্টস শ্রমিকরা বস্তির ঘরে গাদাগাদি থাকেন,  এ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তা করেছি। কিন্তু এই করোনা সময় আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্য প্রকাশিত করলো,  তাদের চেয়ে ব্যারাকে অস্বাস্থ্যকর দিন কাটে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের!

বাংলাদেশের নানা পেশার লোকজন সুরক্ষা সামগ্রী সহ নানাকিছুর জন্যে হা-হুতাশ, প্রতিবাদ করলো, কিন্তু পুলিশ কিছু বললোনা। কারন তার চাকরিবিধিটি এমন, প্রতিবাদের কথা বলে লোকজন সেটিকে বিদ্রোহ শোনে!

অতএব বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আজ করোনায় সবচেয়ে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যু পুলিশের। কিন্তু এরপরও এই করোনা যুদ্ধে বাংলাদেশের পুলিশের যুদ্ধ এরমাঝে দেশের মানুষজনের মনে দাগ কেটেছে।

সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছে এ এক ভিন্ন মানবিক পুলিশ বাংলাদেশের। শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালন সহ, এই পুলিশ খাবার পৌঁছে দেয় ক্ষুধার্ত মানুষের ঘরে। করোনায় কারও মৃত্যু হলে যখন স্বজন পালিয়ে যায়, পালিয়ে যান পাড়ার মৌলভী, তখন পরম মমতায় সে লাশ দাফন করে বাংলাদেশের মানবিক পুলিশ। এই পুলিশকে বাংলাদেশ ভুলবেনা।

এই করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বাংলাদেশের দূর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছে। এর নেতৃত্বে যখন যে ক্ষমতায় এসেছে তার পক্ষে দলবাজি করেছেন। কিন্তু মহামারীর সময় দেখা গেলো বাংলাদেশের রোগ নির্নয় তথা টেস্টের ব্যবস্থাটিই দূর্বল-নড়বড়ে।

বাংলাদেশের দুদকের মতো অস্ট্রেলিয়ায় রয়েল কমিশন নামের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলাদেশে তেমন রয়েল কমিশন যদি থাকতো তাহলে দেশের দুই মেধাবী বক্তা সাবেক দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নাসিমকে কাঠগড়ায় ডেকে নিয়ে জানতে চাইতেন তারা কী করেছিলেন?

বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দেশে চিকিৎসা করাননা। অনেকে উচ্চতর ফোনে ভালো সার্ভিস পান। এরজন্যে এরা কোন দিন এই ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করেননি। কিন্তু এবার সবকিছু নিজে দেখভাল করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানলেন-বুঝলেন কী হাল সাধারন মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থার।

 আমার ধারনা এই অভিজ্ঞতায় ভবিষ্যতে ঘুরে যাবে দেশের বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা। এর আগের মহামারীতে বেহাল হয়েছিল তাইওয়ান। সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার করোনা দূর্যোগ চমৎকার সামাল দিয়েছে দেশটি। দেখবেন আগামীতে বাংলাদেশও পারবে। সবাই শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্যের জন্যে দোয়া করবেন।

আবার এই সময়ে চিকিৎসক কারও কারও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা দারুন এক সার্ভিস দিচ্ছেন। এদের অবদান বাংলাদেশ ভুলবেনা।

নানান আশংকার মধ্যে এই মহামারীর সময়ে এখনও ঢাকার দিকে বানের মতো লোক আসছে। এরা কারও কাছে ত্রানের জন্যে আসছেনা। কাজের জন্যে আসছে। দেখবেন ঈদের সময়ও লোকজন একই রকম যে কোন উপায়ে গ্রামের বাড়ি যাবে।

যেহেতু এদের কোনভাবেই থামানো যাবেনা তাই সবাই যার যার মতো করে নিকটজনকে সাবধান করুন, যার যার নিরাপত্তা দেখেশুনে সবাই যাতে চলেন। ঈদের আগে দোকান খুলছে, মসজিদে নামাজ পড়তে পারার খুশি নিয়েও অনেকে শুকরিয়া জানাচ্ছেন।

এদের অনেকে একটি সত্য হয়তো জানেননা। আপনি একজন ভালো গাড়ি চালক হলেও বেশিরভাগ দূর্ঘটনা কিন্তু অন্য চালকের দোষে হয়। কাজেই এখন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শপিং’এ যাবার ব্যাপারে সাবধান।

 নামাজ আপনি ঘরে পড়লেও আল্লাহ শুনবেন। খুব পজিটিভ একটা ঘটনাও আমরা দেখছি। বসুন্ধরা শপিং মল, ঢাকা নিউ মার্কেট, মৌচাক, আনারকলি মার্কেট সহ অনেক মার্কেট এই মহামারীর সময় খুলছেনা। সিলেটের মার্কেটগুলো খুলছেনা। তাদের এসব দায়িত্ববোধের প্রশংসা করুন।

বাংলাদেশ সরকারের সামর্থ্যের কথা সবাই যাতে নিজেদের দিকে তাকিয়ে মনে রাখেন। ভারতের ধনী ব্যক্তিরা, সেলিব্রেটিরা কি পরিমান দান খয়রাত করছেন আর বাংলাদেশের কী অবস্থা?

 দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের তুলনায় ত্রানের কাজ বেশি যারা করছেন তাদের আর্থিক অবস্থা আহামরি নয়। এমন লোকজনই কিন্তু বাংলাদেশের সব দূর্যোগে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে দেখুন।

আপনার নিজেকে নিজের কাছে দেবতা দেবতা মনে হবে। এখনকার ভেতরের শয়তানটা ভাগবে। মানুষের পক্ষে কাজ করার এমন সুযোগ খুব বেশি আসেনা। এখন সেই সময়। বেঁচে থাকলে প্রশ্ন তোলার সময় অনেক পাবেন।

প্লিজ। মহামারী সবাই মিলে সামাল দিতে হয়। বিশ্বাস করুন বাংলাদেশ বরাবরই নিজস্ব সীমিত সামর্থ্য সবকিছু ফাইট করে জয়ী হয়। এবারেও পারবে। আমি আশাবাদী।