পৃথিবী এখনও ক্লিওপ্যাট্রাকে খুঁজতে আলেকজান্দ্রিয়ায় আসে

এরিস্টেটলের ছাত্র ছিলেন দিমিত্রিয়াস ফ্যালেরিয়াস। আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক টলেমি তার অনুপ্রেরনায় শহরে স্থাপন করেন বিশেষ একটি গবেষনা প্রতিষ্ঠান। দ্য ম্যুজিয়ন। এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিভিন্ন গবেষনাগার, লাইব্রেরি, রিডিং রূম, লেকচার হল।

বিশাল এক সম্মেলনকক্ষ, অতিথিশালা, খাবার ঘর, বাগান, পেরিপাটস পথ এসবও ছিল ম্যুজিয়নের অংশ। আর্কিমিডিস, ইউক্লিড এখানে বসেই তাদের বিখ্যাত সব গবেষনার কাজ করেছেন।

এখানে বসেই আবিষ্কার হয় পৃথিবী নয় সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র। এই আবিষ্কারটি করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এ্যারিস্টার্কাস। এভাবে আজকের যুগের বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্টের ব্যুৎপত্তি হয় প্রাচীনকালের আলেকজান্দ্রিয়ায়।

বাংলাদেশের মতো দেশে এখন একটা কিছু পাশ দিয়ে চাকরি পাবার আশায় অথবা বিয়ের সিভিতে একটি পাশ দেখাতে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল গবেষনার উদ্দেশে।

ভূগোলবিদ্যার জনক ইরাতোস্থিনিস প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ার ম্যুজিয়ন কমপ্লেক্সের অন্যতম অংশ দ্য গ্রেট লাইব্রেরির লাইব্রেইয়ানের পদেও কাজ করেছেন। তখনই তিনি প্রথম প্রমান করেন আমাদের এই পৃথিবীটা গোল।

তখন আলেকজান্দ্রিয়ায় বসেই পৃথিবীর পরিধিও সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারেন ইরাতোস্থিনিস। প্যাপিরাস স্ক্রোলের অদ্বিতীয় সংগ্রহ ছিল এই লাইব্রেরিতে। তখন আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজ বিশেষ একটি অভিজ্ঞতা পেতো!

তাহলো, রাজকর্মীরা জাহাজে উঠে তন্ন তন্ন করে খুঁজতো সেটিতে বিশেষ বিশেষ বই বা ডায়েরি কী আছে! প্রাথমিকভাবে এসব বইপত্র পরীক্ষার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হতো লাইব্রেরিতে। মূল্যবান বই-ডায়েরি মনে হলে সেগুলো বাইজেয়াপ্ত করা হতো।

অথবা এর অনুলিপি রেখে সেটি ফেরত দেয়া হতো জাহাজে। জাহাজের সব লোকজন বুঝতেই পারতোনা এসব বই-ডায়েরি দিয়ে এদের কী দরকার। আগের আমলের রাজন্যদের বই নয়, আগ্রহ ছিল রত্মরাজিতে।

কিন্তু টলেমি যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুসন্ধানের নিত্য নতুন গবেষনা-সংগ্রহের পিছনে ছুটতো!  হতো বই। তখনও মিশরে ভারতীয় উপমহাদেশের রেশম আর মসলাপন্যের বিশেষ চাহিদা ছিল।

জাহাজে করে আনা এসব পন্য লোহিত সাগরের বন্দরে খালাসের পর সড়কপথে আনা হতো আলেকজান্দ্রিয়ায়। এখানে যে বিভিন্ন দেশের পন্ডিতরা গবেষনায় এসে অতিথিশালায় থাকতেন তারা এসব পন্য বিশেষ পছন্দ করতেন।

আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে পাওয়া এক ভ্রমন কাহিনীতে জানা গেছে এ তথ্য। ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে যাওয়া এক জাহাজের তথ্যও একইভাবে জানা গেছে।

খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে জাহাজটি এ পথ দিয়ে ইউরোপে যায়।

সেই জাহাজে ছিল সুগন্ধী গাছের ষাটটি কন্টেইনার, একশ টন হাতির দাঁত এবং আবলুস কাটের বড়সড় চালান। পর্যটক সওদাগরদের বিনোদনের জন্যে তখন থিয়েটার, চিড়িয়াখানা, বার-পতিতালয় সবই ছিল আলেজান্দ্রিয়ায়। 

দুই হাজার বছর আগের সেই সময়ের আলেকজান্দ্রিয়ার হাটেঘাটে বাজারে লেগে থাকতো ভারতীয় চীনা থেকে শুরু করে ইহুদি, গ্রীক, আরব সহ নানাদেশের সওদাগর-নাবিক-জাহাজকর্মী, পর্যটকদের ভিড়।

টলেমি যুগের শেষ শাসক ক্লিওপ্যাট্রোর শাসন সময় পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়া এমনই ছিল একটি আন্তর্জাতিক হাব। আশি খৃষ্ট-পূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়া আনুষ্ঠানিক ভাবে চলে যায় রোমান প্রভাব-বলয়ে।

রো্মান সেনাপতি ও শাসক অক্টাভিয়ান এ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে অ্যান্টনি ও ক্লিওপ্যাট্রাকে পরাজিত করে আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে নেন। এর আগে অবশ্য ইতিহাসের আরও কিছু ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটেছে।

শেষ ফারাও সুন্দরী শাসক ক্লিওপ্যাট্রার বাহুডোরে আত্মহত্যা করেন তার প্রেমিক রোমান শাসক ও সেনাপতি মার্ক অ্যান্টনি। গল্পে আছে এরউত্তরে “আস্প” সাপের ছোবলে আত্মহত্যা করেন তার প্রেমিকা ঈশ্বরসম ফারাও ক্লিওপ্যাট্রা!

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর কখনও এমন ঘটেছিল কিনা জানা যায়না। আলেকজান্দ্রিয়ার পতন। একই সাথে প্রাচীণ দুটি সভ্যতার পতন ও পরিবর্তনের সূচনা!   অ্যান্টনি-ক্লিওপ্যাট্রাকে পরাজিত করে রোমান রাজ।

সেই থেকে সারা পৃথিবীর ইতিহাসবিদ-পর্যটকরা ক্লিওপ্যাট্রাকে খুঁজতে মিশরের এই বন্দর শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় আসেন। শেকসপিয়রের নাটক আর হলিউডে এলিজাবেথ টেলর অভিনীত বিখ্যাত ছবির গুনেও ক্লিওপ্যাট্রা চরিত্রটি ট্র্যাজিডি কুইন।

প্রাচীন মিশরের টলেমি বংশের সদস্যা ছিলেন ক্লিওপ্যাট্রা। টলেমি বংশের লোকজন গ্রিক ভাষাতে কথা বলতেন। মিশরীয় ভাষা শিখতে চাইতেননা। ব্যতিক্রম ছিলেন ক্লিওপ্যাট্রা। তিনি মিশরীয় শিখেছিলেন।

তাঁর মাঝে দেখা হতো মিশরীয় দেবীর পুনর্জন্ম। বাবা চতুর্দশ টলেমি অলেটেসের সঙ্গে দ্বৈতভাবে মিশর শাসন করতেন ক্লিওপ্যাট্রা। বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাই ত্রয়োদশ টলেমি আর চতুর্দশ টলেমির সঙ্গে তিনি শুরু করেন রাজ্যশাসন।

মিশরের তৎকালীন ঐতিহ্য অনুসারে তিনি তাদের বিয়েও করেছিলেন। পরে ক্লিওপ্যাট্রা মিশরের একক শাসক হিসাবেও অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ফারাও সম্রাজ্ঞী হিসাবে রোম শাসক গাউস জুলিয়াস সিজারের সঙ্গেও তিনি ভালো সম্পর্ক রাখছিলেন।

এরকারনে মিশর সিংহাসনে ক্লিওপ্যাট্রার অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়। জুলিয়াস সিজারের নামে ক্লিওপ্যাট্রা তাঁর বড়ছেলের নাম রাখেন সিজারিওন। উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটকে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে ক্লিওপ্যাট্রার প্রেমকাহিনী।

শেকসপিয়র লিখেছেন অ্যান্টনি-ক্লিওপ্যাট্রা। জর্জ বানার্ড শ লিখেছেন সিজার-ক্লিওপ্যাট্রা। বিশ্বের নামকরা সব সাহিত্যে প্রাধান্য পেয়েছেন ক্লিওপ্যাট্রার প্রেম ও উচ্চাকাংখা।

সবাই যার যার আশ্চর্য সব দক্ষতায় ক্লিওপ্যাট্রার রূপ বর্ননা করেছেন। বিখ্যাত লেখক হেনরি রাইডার হগার্ডের লেখা উপন্যাসে ক্লিওপ্যাট্রায় তিনি কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিলেও সেখানে ফুটে উঠেছে ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাষ।

 আর কিছুটা নারীসুলভ অসহায়ত্ব। ক্লিওপ্যাট্রার চরিত্র নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল প্রমুখ। ফলে হাজার হাজার বছর পরও ক্লিওপ্যাট্রার প্রেম নিয়ে আলোচনা চলছে আজও।

থেমে নেই লেখালেখিও। দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নারী শাসক ক্লিওপ্যাট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা যান।

মারা যাওয়ার আগে তার বিশাল সাম্রাজ্য ১৮ বছর বয়সী মেয়ে ক্লিওপ্যাট্রা ও ছেলে টলেমি-১৩-কে উইল করে দিয়ে যান। সেই সঙ্গে রাজ্য ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে যান রোমান নেতা পম্পেকে।

 তখনকার মিশরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপ্যাট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপ্যাট্রাকে তখন তাঁর ছোট ভাই  টলেমি-১৩ কে বিয়ে করতে হয়!  

টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। কাজেই আইনগতভাবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার পড়ে ক্লিওপ্যাট্রা এবং তার স্বামী ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই ত্রয়োদশ টলেমি’র ওপর।

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও শাসন চালিয়ে যান  ক্লিওপ্যাট্রা। এরমাঝে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ফারসালুসের যুদ্ধে পরাজিত হন সেনাপতি পম্পে। আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে ফারসালুসের হাতে নিহত হন সেনাপতি।

যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে মারা যান ক্লিওপ্যাট্রার স্বামী ও ভাই ত্রয়োদশ টলেমি। তাঁর মৃত্যুর পর ক্লিওপ্যাট্রা হয়ে ওঠেন মিশরের একচ্ছত্র রানী। এরমধ্যেই দৃশ্যপটে আবির্ভাব রোমের পরাক্রমশালী বীর মার্ক অ্যান্টনির।  

ক্লিওপ্যাট্রার রূপ-লাবণ্যের কথা অ্যান্টনি শুনেছিলেন নানামুখে। তাঁকে সামনা-সামনি দেখতে একদিন তিনি রোম থেকে  ক্লিওপ্যাট্রার কারুকার্যশোভিত প্রাসাদের সামনে চলে আসেন।

অ্যান্টনির আসার খবর পেয়ে গেলেন রানী। মার্ক অ্যান্টনির কথা তিনিও আগে নানাভাবে শুনেছেন। সেখান থেকে প্রেমের শুরু। অবশ্য কারও কারও মতে মিশর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপ্যাট্রার প্রেমে পড়ে যান অ্যান্টনি।

 কোন কোন ইতিহাসবিদের মতে প্রথম দর্শনেই ক্লিওপ্যাট্রা-অ্যান্টনি একে অন্যের প্রেমে পড়ে যান। অ্যান্টনির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রকট রূপ নিল। ক্লিওপ্যাট্রার রূপে মোমের মতো গলে পড়তে শুরু করেন রোমান বীর।

প্রথম থেকে শুধু একজন আরেকজনের দিকে কেবলই অপলক তাকিয়ে থাকা। একজন আরেকজনকে যত দেখেন, ততই দেখার আকর্ষণ বাড়ে। পড়েনা চোখের পলক! আর অ্যান্টনি দেখেন শুধু ক্লিওপ্যাট্রার রূপের ঝলক।

এরপর একে অন্যের মধ্যে ক্লিওপ্যাট্রা-অ্যান্টনি দেখতে লাগলেন তাদের পরবর্তী জীবন। ক্লিওপ্যাট্রার প্রেমে মশগুল মার্ক অ্যান্টনি। আর ক্লিওপ্যাট্রাও তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের একজন সঙ্গী পেয়ে গেলেন।

 আর তাঁর সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন পেয়ে গেলেন। এরপর থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে মার্ক অ্যান্টনিওর জীবন।

স্ত্রী ফুলভিয়ার মৃত্যু এবং পম্পের বিদ্রোহ ঘোষণায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল অ্যান্টনির সুবর্ণ সময়। গৃহযুদ্ধে রীতিমতো বিপর্যস্ত রোম। গল্পে এরপর যোগ হয় ভিন্নমাত্রা!

সুন্দরী ক্লিওপ্যাট্রার জীবনে আসেন মধ্যবয়সী বীর জুলিয়াস সিজার। এলোমেলো মুহূর্তে সিজারকেও আঁকড়ে ধরেন ক্লিওপ্যাট্রা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। আত্মহত্যা করেন অসহায় অ্যান্টনি।