কায়রোর নীল নদীর পানি নীল নয়

মিশরকে বলা হয় নীল নদের দেশ। ইংরেজি নাম দ্য নাইল রিভার। কিন্তু কায়রো শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি নীল নয়। পানিটা ঘোলাটে। এটাকে অবশ্য এরা বলে দ্য হোয়াইট নাইল।

এই নীল নদটাকে এরা সাদা, নীল এই দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। দুটি পৃথক উৎস থেকে এই দুটি ধারার নদীর উৎপত্তি। সাদা অথবা ঘোলা পানির নদীর উৎপত্তির উৎস আফ্রিকা। আবিসিনিয়ান মালভূমি থেকে উৎপত্তি নীল নদের। দুই নদীর গন্তব্য অভিন্ন। ভূমধ্যসাগর।

নীল নদকে বলা হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী। ৬ হাজার ৬৫০ কিঃমিঃ লম্বা এই নদী। প্রাচীন সভ্যতার অনেক কিছুর সৃষ্টি এই মিশরে। কৃষি প্রথম শুরু হয়েছে মিশরে। টেক্সটাইল তথা বস্ত্র শিল্পের শুরু মিশরে। নগর সভ্যতার শুরু মিশরে। মরুভূমির দেশে সঙ্গে এমন একটি নদী থাকায় মিশরের কৃষিও খুব সমৃদ্ধ।
কায়রোর বাজারগুলোতে গেলে এদের কৃষিপণ্যের সম্ভার দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। হৃষ্টপুষ্ট আলু, টমেটো থেকে শুরু করে বেগুন, ফুলকপি-পাতাকপি কি নেই! নীল নদে বাঁধ দিয়ে সেচের পানির ব্যবস্থা করে এই দেশ তাদের কৃষিকে এমন সমৃদ্ধ করেছে।

কায়রো শহরের মধ্যে দাঁড়ানো আলো ঝলসানো সবচেয়ে বনেদি হোটেলও এই নীলনদের নামে। দ্য নাইল রিটজ কার্লটন ইন্টারন্যাশনাল। কায়রো পৌঁছার পর থেকে তোয়াব ভাই বারবার শুধু ফোনে আদেশ দিচ্ছিলেন নাগিব মাহফুজকে খুঁজে বের করে তাঁর ইন্টারভ্যু করতে হবে।

নাগিব মাহফুজ নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মিশরীয় কবি। এখানে এই ফাঁকে আমার মিশর যাবার কারন বলে নেই।

জনকন্ঠের তখন ভরা যৌবন। সর্বাধিক প্রচারিত উজ্জ্বল দিনগুলোতে পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান তথা আমাদের সাংবাদিকতার প্রধান শিক্ষক তোয়াব খান সিদ্ধান্ত নিলেন রিপোর্টারদের কাউকে না কাউকে সব সময় বিদেশে রাখবেন।

এতে করে সারা বছর পত্রিকাটায় এমন একটি আলাদা টেস্ট থাকবে যা অন্য পত্রিকায় নেই। সেই সিদ্ধান্তে তখন আমাকে প্যালেস্টাইন তথা ফিলিস্তিনের উদ্দেশে মিশর-জর্দানে পাঠানো হয়।

আজকের মতো তখন ইন্টারনেট-পত্রিকার অনলাইন সংস্করন নেই। হাতে আমাদের মোবাইল ফোন নেই। তাই পাঠানো রিপোর্ট পত্রিকায় প্রতিদিন কিভাবে ছাপা হচ্ছে তা দেখিনা। অনলাইন থাকলে দেখার সুযোগ থাকতো।

কিন্তু তোয়াব ভাইর কারনে প্রতিদিন আপডেট থাকতাম। একজন পিতার মতো একজন শিক্ষকের মতো তোয়াব ভাই প্রতিদিন আমার কায়রোর ডেরায় ফোন করতেন।

তখন কেমন আছি কেমন লাগছে এসব জানতে চেয়ে প্রতিদিনের রিপোর্ট নিয়ে আলাপ করতেন। রিপোর্ট কেমন হচ্ছে আর কী কী করলে ভালো হবে, রিপোর্ট কী ট্রিটমেন্টে ছাপা হয়েছে, এসব প্রতিদিন বলতেন তোয়াব ভাই।

আমি কায়রো গিয়েছি পিরামিড নীল নদ দেখতে নয়। ফিলিস্তিন যাবার উদ্দেশে আমার কায়রো যাওয়া। ফিলিস্তিনে তখন ইসরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে ইন্তিফাদা নামের গণআন্দোলন তখন চলছে

এই ইন্দিফাদা নিয়ে এজেন্সি রিপোর্ট প্রতিদিন বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল। আলাদা করে রিপোর্টার পাঠানোর কারন বাংলাদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের পাঠকদের টেস্ট জানে।

তখন শাহতা জারাব ছিলেন বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত। তিনি পিএলও তথা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের কায়রো ও আম্মান অফিসকে আমাকে ফিলিস্তিনি নিয়ে যাবার অনুরোধ করে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন।

কিন্তু পিএলও’র কায়রো অফিস চেষ্টা করেও আমাকে সে দেশে নিয়ে যাবার কোন পথ করতে পারছিলোনা। কারন আমার বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্ট। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটি আসলে একটি পরাধীন টেরিটোরির নাম।

এর সীমান্ত নিয়ন্ত্রন করে চির শত্রু রাষ্ট্র ইসরাইল। ভিসা দেয় ইসরাইল। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাই ভিসার জন্যে তাদেরকে বলাই যাচ্ছিলোনা।
এমন বাস্তবতার কারনে আমি ইন্দিফাদার রিপোর্ট করার জন্যে বিকল্প কিছু পথ করে নিয়েছিলাম। এরজন্যে মধ্যপ্রাচ্য নিউজ এজেন্সির কায়রো অফিস আমাকে সহায়তা দিচ্ছিলো। তাদের নিউজের একটি প্যাকেট কিনতাম প্রতিদিন।

এছাড়া ফিলিস্তিনের ভেতরে থাকা কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতাম। আরেকটা মজার একটা আবিষ্কারও তখন আমার ছিল। ফিলিস্তিনের ভেতরে থাকা কিছু বাংলাদেশির সন্ধান আমি পেয়েছিলাম।

এরা কাজের খোঁজে মিশর-জর্দান থেকে ফিলিস্তিনে চলে গিয়েছিলেন। ভালো কাজ করেন। তাই কারখানার মালিকরা এমন শ্রমিকদের ধরে রাখতে কারখানার ভিতরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে।

তারা সেখান থেকে পারতপক্ষে বেরুতেননা। ওয়ের্স্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতেন। এমন নানা সূত্রে পাওয়া ইন্দিফাদার রিপোর্ট তখন আমাকে কায়রো ডেটলাইনে লিখতে হয়েছে।

ওই সময়ে আরেকটা ঘটনা ঘটে। হযরত মোহাম্মদকে (দঃ) ব্যাঙ্গ করে একটি কার্টুন এঁকেছিলেন ইসরাইলি এক কার্টুনিস্ট। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশে তখন একটি হরতাল হয়।
কায়রোতে তখন একটি ইসলামী সম্মেলন চলছিল। সেই সম্মেলনে পরিচিত হওয়া একজন ইসলামিক স্কলার আমার কাছে জানতে চান এর প্রতিবাদে বাংলাদেশে হরতাল করার কারন কী?

তাঁর কথা, বাংলাদেশের সঙ্গেতো ইসরাইলের কোন সীমান্ত, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাহলে বাংলাদেশ নিজের দেশের লোকজনকে কষ্ট দিতে এভাবে হরতাল করলো কেনো?

বিদেশে গেলে বিদেশিদের কাছে দেশ নিয়ে এমন অনেক প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর আমি দিতে পারিনা। কারন এতে দেশের বদনাম করা হয়ে যায়। আমি কখনো কোন বিদেশির কাছে আমার দেশের বদনাম করতে পারিনা। এটি কারোরই করা উচিত নয়।

ওই স্কলারের বক্তব্য ইসরাইলি ওই কার্টুনিস্টের ধৃষ্ট আচরনের নিন্দা করে মিশর সরকার বিবৃতি দিয়েছে। জুম্মার খুতবায় এর নিন্দা করা হয়েছে। এটিই এনাফ। কোন ইস্যুতে কোন একটি দেশের কাজ কখনো বন্ধ রাখা উচিত নয়। এতে সে দেশ দূর্বল হয়।

নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মিশরীয় কবি নাগিব মাহফুজের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও আমি তেমন একটি পরিস্থিতিতে পড়েছি। প্রথম খোঁজ বের করতে হয়েছে নাগিব মাহফুজের বাড়ি।
কায়রো শহরের মধ্যে পাথরের স্লাবে তৈরি সাদামাটা একটা বাড়ি নাগিব মাহফুজের। অনেক মিশরীয়র বাড়ির দেয়াল এমন পাথরের স্ল্যাবের। মরভূমিতে এমন অনেক পাথুরে পাহাড় আছে।

কবি আমাকে এক বিকেলে সাক্ষাৎকারের জন্যে সময় দিলেন দ্য নাইল রিটজ কার্লটন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের লবিতে।
সেখানে গিয়ে বুঝতে পারি কায়রোয় থাকলে মোটামুটিতে সেই লবিতেই আড্ডা মারতে আসেন নাগিব মাহফুজ। আমিতো তাঁর কাছে অবিরাম প্রশংসা করছিলাম আমার দেশের। ভাষার জন্যে আত্মত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলার পর বললাম বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ব এর সমাজ মানসিকতাকে চেনায়।

কিন্তু নাগিব মাহফুজ তুললেন তসলিমা নাসরিনের কথা। বুঝতে পারি বাংলাদেশ নিয়ে তিনি যতোটা জানেন তা মূলত তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নানা রিপোর্টের যোগফল।

আমাকে তিনি বলেন যে দেশে ভাষার জন্যে সংগ্রাম হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ করে যে জাতি নিজের দেশ স্বাধীন করেছে, সে দেশ একজন কবিকে কিভাবে তাড়িয়ে দেয়? তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে অনেক দেশের মতো নিশ্চয় বাংলাদেশেও দূর্নীতিবাজ ব্যক্তি, চোরাকারবারীর মতো অনেক খারাপ মানুষ আছেন।
কিন্তু একজন কবিতো সে তুলনায় অতো বিপদজ্জনক নন যে তাকে দেশ ছাড়া করে রাখতে হবে। কবিরা খুব দূর্বল নরম মনের হয়। ভিন্নমতের কারনে একজন কবিকে কাঁদিয়ে একটা দেশ একটা জাতি কখনো মহান হয়না।

আমাকে তিনি বললেন তুমি বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে এ নিয়ে বেশি বেশি লিখবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবির কবিতার দেশের একজন কবির একজন নারীর ভিন্ন দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো বাংলাদেশের জন্যে মোটেই মর্যাদার নয়।