ভাবছিলাম আত্মহত্যাটা করেই ফেলি!

অনেক দিন পর আবার ডায়েরীটা হাতে নিলাম। প্রায় ১১ বছর পর। এতোদিন নানা ব্যাস্ততায় আর ডায়েরী লেখা হয়ে উঠে নি। ডায়েরীটা চেনার কোন উপায় নেই। ধবল রঙ্গের ডায়েরীটা ধুসর বর্ণ ধারণ করেছে। ডায়েরীটাতে হাত রাখলেই কেন যেন তনুর কথা খুব মনে পড়ে যায়। আমার জন্মদিনে দেয়া তার শেষ উপহার এটি।

ও আচ্ছা, কেন আজ ডায়েরীতে লিখতে বসলাম তা তো বলাই হয় নি। হ্যাঁ, আজ ছিল আমার শেষ কর্ম দিবস। এ কথাটা আমি আমার স্ত্রী তিথিকে বলিনি। আমার সন্তান, বাবা মা কেউ জানে না। কদিন ধরে তিথি আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করেছিল তোমাকে এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন? অফিসে কোন ঝামেলা হয়নি তো। তিথিকে নিয়ে এ এক ঝামেলা। সবার কাছে সব কিছু লুকানো গেলেও এ মেয়েটার কাছ থেকে পালানোর কোন উপায় নেই আমার।

এ অফিসে প্রায় ১ যুগ কাটানোর পর এভাবে বিদায় নিতে হবে কোন দিন ভাবি নি। বার বার মনে হচ্ছিল বাবার কথা মেনে কেন সরকারী চাকুরীতে ট্রাই করিনি? কর্পোরেট জগতের একটা মোহ কাজ করেছিল সব সময়। ভালই যাচ্ছিল দিন গুলি। কিন্তু গত মাসে বস মিটিং রুমে ডেকে নিয়ে করনা কালীন বিজনেসের অবস্থা নিয়ে কথা বলতেই বুঝতে পারলাম এ কোম্পানীতে আমার ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হচ্ছে খুব শিগগিরি। নিজের কনফিডেন্সের বেলুনটা চুপসে যাচ্ছিল। প্রতিদিন মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা করি। কিন্ত প্রিয় সন্তানের মুখটা ভেসে আসছিল বার বার…

অফিস থেকে আসার সময় কাউকে বলে আসি নি। বলতে ইচ্ছেও করছিল না। অফিসের গাড়ীর চাবিটা আমার ড্রাইভারের হাতে দিতেই তার নিঃশব্দে অশ্রু বিয়োগ দেখে মনটাকে সামলাতে পারছিলাম না। তার সাথে কত স্মৃতি! একেবারে আমার পরিবারের একজন সদস্যের মত।

অনেকদিন পর এই প্রথম রিক্সায় উঠলাম। তনুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে কত রিক্সা ঘুরেছি… কেন যেন সেসব দিন গুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পকেটে থাকা মুঠোফোনে শিলার কল। কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল – “ফুয়াদ তুই কই?” আমি উত্তর দেবার আগেই সে আবার বলে উঠল “প্লিজ তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে আয়”। মুঠোফোনের ওপারে কোন শব্দ না পেয়ে আমি একটা সি এন জি নিয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলের দিকে ছুটে গেলাম। শিলার ফর্সা চাহনিতে কেমন যেন ক্লান্তির ছাপ। আমাকে দেখেই হাউ মাউ করে কেঁদে বলে উঠল – “ফুয়াদ, আমার সব শেষ হয়ে গেছেরে ফুয়াদ। সুমনের করনা পজিটিভ ছিল। তেমন কাউকে জানাইনি। ওর বাবা মা দুজনই দেশের বাইরে। কিছুক্ষন আগে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ফুয়াদ…” শিলাকে সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা আমার জানা ছিল না। সুমন আমার খুব কাছের বন্ধু। প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী। মূলত পারিবারিক ব্যাবসাটাকে ও অনেক বড় আকারে রুপ দিয়েছিল। আমি হাসপাতালের সব ফরমালিটি শেষ করে আজিমপুর কবরস্থানে সুমনকে শেষ ঘুম পাড়িয়ে আসলাম। শিলা তার মায়ের বাসায় চলে গেল।

গত একমাস ভাবছিলাম কিভাবে আমার আগামী মাস গুলো যাবে? ফ্ল্যাটের লোনের কিস্তি, ক্রেডিট কার্ডের বিল, বাচ্চার স্কুল ফি, বৃদ্ধ বাবা মায়ের ঔষধ সহ এ ঢাকা শহরের কত খরচ…তাছাড়া আমার নেই কোন সেভিংস! আজ আমার প্রিয় বন্ধু সুমনের অবস্থা চিন্তা করতেই মনে হল – “আমি হয়ত আজ ভালো নেই, বেঁচে তো আছি!”তাছাড়া আমি কারো করুণায় এতোদিন চাকুরি করিনি। আমার মেধা দিয়ে আজ না হয় কাল একটা ভালো চাকুরী পাব এ বিশ্বাস আমরা আছে”।

কেন যেন আজ আত্মহত্যা না করে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে”!

– ফুয়াদ, ৩০ এপ্রিল ২০২০ (রাত ১১ টা ৩০ মিনিট )