বিদিশায় বেদিশা জাতীয় পার্টি

ফজলুল বারী: বিদিশায় বেদিশা জাতীয় পার্টি। এ নিয়ে যত রিপোর্ট হচ্ছে তাতে কী শরম পাচ্ছেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা? শরম পাবার কিছু নেই। কারন এটিই জাতীয় পার্টি। নানান মিথ্যা আর বেশরম কায়কারবারের ওপর এ দলটি প্রতিষ্ঠিত-বিকশিত। এবং এরসবই এরশাদের কীর্তি। একটা দল সম্পর্কে এমন সাফ সাফ কথা কিভাবে লিখছি তাইনা ? ওয়েট অ্যান্ড সী। এর পুরো ব্যাখ্যা দেবো। এরশাদ-বিদিশা দু’জনেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন জানতেন। আজ  এরিখ-বিদিশা টানোপোড়েনের সঙ্গে জড়িত জি এম কাদের, মেজর (অবঃ) খালেদও চিনতেন জানতেন আমাকে। তাদের আজকালকার  কথাবার্তা দেখেশুনে হাসিও পায়। কারন সময় এবং কথার সুর পাল্টেছে। এরশাদের জীবদ্দশায় এ দলের আজকের অনেক নেতা এরশাদের বেতনভূক্ত কর্মচারী ছিলেন। মাসে মাসে তাদের বেতন পরিশোধ করা হতো। অতএব ‘আহার যিনি দেন’ তার গুনকীর্তন-মনোরঞ্জনই ছিল তাদের কাজ।

এখন বিদিশা কাহিনী লিখি সংক্ষেপে। ঢাকায় দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন শাহতা জারাব। আজিজ মোহাম্মদ ভাই’র মতো ঢাকার মদ-নারীর জগতের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিল এই শাহতা জারাবের। মূলত তার মাধ্যমেই  বিদিশার সঙ্গে এরশাদের পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা। কবি আবু বকর সিদ্দিকীর মেয়ে বিদিশার প্রথম ছিলেন স্বামী ব্রিটিশ। ওই সংসারে তার বড় দুই ছেলেও আছে। এরশাদের না হয় পটেটো সমস্যা ছিল, পিতৃতূল্য এবং বুড়ো সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রতি বিদিশার আসক্তির কারন কী ছিল? জাতীয় পার্টির তখনকার নেতাকর্মীরা এ নিয়ে বলতেন, জাস্ট সম্পদ। দেশেবিদেশে এরশাদের সম্পদ। মনে করা হয় জনতা টাওয়ার মামলায় এরশাদ জেলে যাবার আগে কখনো তাদের বিয়ে হয়। কোন কাঁচা কাজ করেননি বিদিশা। কাবিননামা সহ কাগজপত্র ঠিকঠাক সব বুঝে নিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টি মজার এক পার্টি। আমি এ দলের নেতাদের বলতাম, আপনাদের পার্টির তথ্যাদি শুনতে মজা লাগে, লিখতে মজা লাগে, পড়তে মজা লাগে। এমন নাচেগানে ভরপুর সেক্স-ক্রাইম সহ সম্পূর্ন রঙ্গিন দল দ্বিতীয়টি বাংলাদেশে নেই। জাতীয় পার্টির রিপোর্ট করতে গিয়ে আরেকটি বিষয় আমি এনজয় করতাম। তাহলো যে কোন বিষয়ে সরাসরি ফোনে এরশাদের সঙ্গে কথা বলা যেতো। আর পজিটিভ-নেগেটিভ যাই হোক, এ দলের নেতারা চাইতেন দলের খবর মিডিয়ায় থাকুক।

 এরশাদ যখন জনতা টাওয়ার মামলার সাজা নিয়ে জেলে যান তখন নাজিউর রহমান মঞ্জুর ছিলেন জাপার মহাসচিব। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে এরশাদের জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর, আ স ম আব্দুর রব তখন জাতীয় ঐক্যের সরকারের মন্ত্রীও হন। আবার মুক্তি পেয়ে এরশাদ মঞ্জুরকে সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে বললে দল ভাঙ্গে। মঞ্জুর গড়েন আলাদা জাতীয় পার্টি। নাজিউর রহমান মঞ্জুর হন জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব। নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে বলা হতো এরশাদের খাজাঞ্চি। এরশাদের চুরি-দুর্নীতির অনেক সম্পদ নাজিউরের নামে করেছিলেন। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দৈনিক জনতার প্রেস তথা এশিয়াটিক প্রিন্টিক প্রেস সহ অনেক সম্পদ নাজিউরের নামে করা হয়েছিল। সময়মতো মতো এসব সম্পদসহ ভাগল দেন নাজিউর। চুরি-দুর্নীতির সম্পদতো। এরশাদ কোনদিন মুখ ফুটে এসব দাবি করতে পারেননি।

সবাই আজকাল জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের গাঁটছড়ার কথা জানেন। কিন্তু এই প্রজন্ম জানেইনা জাতীয় পার্টি-জামায়াতকে নিয়ে প্রথম চারদলীয় জোট গঠন করেছিল বিএনপি। কিন্তু এই জোটগঠনের পর ক্যাসেট কেলেংকারি মামলায় হৈচৈ, জনতা টাওয়ার মামলায় এরশাদের জেল হলে বিএনপি এরশাদের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি না দেয়ায় জোট ভেঙ্গে যায়। জনসভার মঞ্চে রওশনকে খালেদা জিয়ার পায়ের কাছে বসানোর অভিযোগও ওঠে। এরশাদ আবার জেলে গেলে পুরাতন ঢাকার সাবেক কারাগারের পাশের এক ভবনের ছাদে নেয়া হতো বিদিশাকে। সেখান থেকে জাতীয় পার্টির নায়ক-নায়িকার দৃষ্টি বিনিময় হতো। ওই সময় নাজিউর রহমান মঞ্জুর এরশাদ-বিদিশার কিছু চিঠির ফটোকপি দেন। জেলখানায় এরশাদ-বিদিশার যে সব চিঠি বিনিময় হতো এসবের কপি জাতীয় পার্টির মহাসচিব একজন রিপোর্টারকে দিচ্ছেন! তা থেকেই বুঝতে পারি ইনি ভাগলপুর হচ্ছেন। এরআগে এরশাদ-বিচারকের টেলিফোনে কথোপকথনের ক্যাসেটও নাজিউর বঙ্গভবনে পাঠিয়েছিলেন। এরশাদ-বিদিশার ওইসব চিঠি নিয়ে আমি রিপোর্ট করিনি। বিষয়টি অরূচিকর মনে হয়েছে। ওইসব চিঠিতেই এরিখের জন্মের আভাস ছিল। এরশাদ জেল থেকে বেরিয়ে আমাকে বলেন, আমি জানতাম ওই চিঠিগুলো পেয়েও তুমি রিপোর্ট করোনি। তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি ইয়েলো জার্নালিজম করোনা। এরশাদের ওই ফোন পেয়ে আমি হেসেছি। এরাই দেশের নেতা!

একবার জাতীয় পার্টির এক নেতা বিদিশার একটি ফোন নাম্বার আমাকে দেন। তার ইচ্ছা ছিল আমি যাতে বিদিশার সঙ্গে কথা বলি। আমার হাতে তখন অনেক রিপোর্ট। বিদিশার সঙ্গে কথা বলার সময় অথবা প্রয়োজন ছিলোনা। একদিন হঠাৎ শুনি প্রেসিডেন্ট পার্কে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। এরিখের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেখানে এরশাদ-বিদিশার বিয়ের ঘোষনা দেয়া হবে। এরশাদের ঘনিষ্ঠ শিল্পী কালাম মাহমুদ এ উপলক্ষে তার ঘনিষ্ঠ কিছু রিপোর্টারকে দাওয়াত করেছেন। খবরটি পেয়ে সেই প্রথম আমি বিদিশাকে ফোন করে জানতে চাইলাম খবরটি সত্যি কিনা। আপনার কী স্বীকৃতি আসছে আজ? বিদিশা তখন বলেন, হ্যাঁ বারী ভাই। যা শুনেছেন তা সত্যি। আমাদের জন্যে দোয়া করবেন। এই হচ্ছে জাতীয় পার্টি। তখন এই বিদিশা ছিলেন আজকের মেজর খালেদের ছোট চাচী। জি এম কাদেরের ছোট ভাবী।

 এরশাদের ফুলের মতো পবিত্র চরিত্র নিয়ে জাতীয় পার্টির আরও দূর্গতি গেছে। হঠাৎ সংবাদ পত্রিকাকে ইন্টারভ্যু দিয়ে এরশাদ বলেন জিনাত মোশাররফের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। পরকীয়া প্রকাশের পর জিনাতের ঘর ভাঙ্গে। তার স্বামী মোশাররফ হোসেন তাকে তালাক দেন। ওই ঘোষনার পর এক মৌলভী তখন পরকীয়া জেনার অভিযোগে এরশাদকে দোররা মারার ফতোয়াও দিয়েছিলেন। এরশাদ বিদিশাকে বিয়ে করার পর জিনাত আমাকে বলেন আমার কাছে যখন ছিল ভালো বংশের মেয়ের কাছে ছিল। এখন সে গেলো কই? রওশনের উদ্দেশে কথাগুলো ছিল জিনাতের। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দলের হয়ে জিনাত সংরক্ষিত আসনে এমপিও হয়েছিলেন। সংসদ ভবনের লাইব্রেরিতে একদিন জিনাত আমাকে বলেন খালেদা জিয়া তার ঘর ভেঙ্গেছেন। শেখ হাসিনা তার আবার জোড়া লাগিয়ে দেবেন। বিএনপির হয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন জিনাতের সাবেক স্বামী মোশাররফ। পরে নাইকো দুর্নীতি ইস্যুতে তার চাকরি যায়।

বিদিশার সঙ্গে সরকারের সময়েই এরশাদ নানা সম্পদ তাকে লিখে দিচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট পার্কের একটি ফ্ল্যাটও তখন তাকে লিখে দেয়া হয়। জাতীয় পার্টির এক নেতা তখন আমাকে বলেন, চিন্তা করবেননা, সব জাল দলিল। এসবের একটা সম্পত্তিও বিদিশা পাবেনা। রেজা নামের এক কর্মচারীকে দিয়ে এরশাদ তখন ওই দলিলগুলো করান। জাতীয় পার্টিতে তার নাম ছিল জাল রেজা। সাতক্ষীরার একটি আসন থেকে তাকে একবার এমপিও করা হয়। কিন্তু সেই জাল রেজার আর চাকরিও নেই। তার আর পার্টিও নেই। জাল রেজার কোন সম্পত্তি বিদিশাও শেষ পর্যন্ত পাননি। কিন্তু এবার বিদিশার নানা দৃঢ়তায় মনে হচ্ছে এরিখকে কেন্দ্র করে ট্রাস্টের নানান দলিল তিনি ভালো কোন ল-ফার্মকে দিয়ে করিয়েছেন। এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির মালিকানা দেবর-ভাবী কার হাতে থাকবে এ নিয়ে যখন জি এম কাদের-রওশনগং ব্যস্ত, তখন এরশাদকে দিয়ে ট্রাস্টের দলিল দস্তাবেজ করাচ্ছিলেন বিদিশা।

 বিয়ে করার পর বিদিশাকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য করেন এরশাদ। প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েই দলের ছোট ম্যাডাম কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় পার্টির হায়ারিং ফায়ারিং অথরিটি হয়ে ওঠেন! আজ  অমুককে প্রমোশন দেনতো কাল অমুককে দেন ডিমোশন! এই জি এম কাদের, মেজর (অবঃ) তখন ছিলেন বিদিশাপন্থী। জাতীয় পার্টি নামের দলটা এরশাদের দুই স্ত্রী রওশন-বিদিশায় ভাগ হয়ে গিয়েছিল। জাতীয় পার্টির বুদ্ধিমান নেতাদের অবশ্য নীতি ছিল ‘স্যার যখন যেদিকে’! কারন সবাই জানতেন এ দোকানের মালিক এরশাদ। দোকান পরিচালনার কোথাও রওশনের কোন ভূমিকা অথবা প্রভাব নেই। এরশাদ বিদিশাকে বিয়ে করার আগে থেকেই রওশন গুলশানে আর এরশাদ প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকা শুরু করেন। তখন থেকেই দু’জনের দুটি পথ চলে যায় দু’দিকে। স্বামী-স্ত্রী হিসাবে এক ছাদের নীচের জীবন তাদের আর হয়নি। পারষ্পরিক আকর্ষনও ছিলোনা। যদিও বিভিন্ন সময়ে এমন রিপোর্টও হয়েছে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করায় মামলা করতে পারেন রওশন। কিন্তু  বরাবরই সম্পত্তিতে বুদ্ধিমতি এ নিয়ে কোন প্রকাশ্য ঘাটাঘাটিতে যাননি। আরও আরও সম্পদ আহরন করেছেন।

বিদিশা যখন জাতীয় পার্টিতে সক্রিয়, রওশন এরশাদ তখন বেশ কিছুদিন দলীয় কাজকর্মে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে অবশ্য রওশনকে রাজনীতিতে আনেননি। ফার্স্টলেডি পদ-অফিস দিয়ে ব্যস্ত রাখেন রওশনকে। আর এরশাদের তখন জিনাত মোশাররফ, নীলা চৌধুরী, নাশিদ কামাল সহ নানান বান্ধবী যুগ। একেক বান্ধবী নিয়ে ঢলাঢলি বাড়লে তখন বাড়তি নতুন কিছু বিষয়-সম্পদ দিয়ে রওশনের মুখ বন্ধ করতেন। এভাবেই কিন্তু এরশাদের চাইতে রওশনের সম্পদ বেশি। নিঃসন্তান হিসাবে যাতে কোন সামাজিক সমস্যা না হয় তখন এই সাদ এরশাদের ব্যবস্থা করা হয়। আতাউর রহমান খান তাঁর ‘প্রধানমন্ত্রীত্বের নয় মাস’ গ্রন্থে এই সাদ এরশাদের আবিষ্কার কাহিনী লিখেছেন। এরজন্যে জীবিতাবস্থায় এই ছেলেকে কখনও সামনেও আনেননি এরশাদ-রওশন। প্রেসিডেন্ট-ফার্স্টলেডি হিসাবে এরশাদ-রওশন যখন বিদেশে যেতেন তখনও এই ছেলেকে কখনও সঙ্গে নিতেননা। রংপুরেও নয়।

এরিখের জন্ম নিয়ে সাদের মতো আলোচনা বাড়েনি। এটি হয়তো এরিখ অটিস্টিক চাইল্ড হবার কারনে। জন্মের পর থেকে এরিখকে চিকিৎসার জন্যে ভারতে নিয়ে যেতেন বিদিশা। এরশাদ তার এই দ্বিতীয় স্ত্রীকে এক পর্যায়ে চুরির মামলায় গ্রেফতার করান। কামরাঙ্গির চরের এক কাজীর মাধ্যমে তালাকও দেন। বিদিশাকে গ্রেফতার করতে পুলিশ যখন প্রেসিডেন্ট পার্ক ঘিরে ফেলে তখন তিনি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। নীচে দাঁড়িয়ে মেয়েকে নিবৃত্ত করেন তার কবি বাবা। হঠাৎ এরশাদের সঙ্গে কী সমস্যা দেখা দিয়েছিল বিদিশার? জাতীয় পার্টির নেতারা তখন এরজন্যে তারেক রহমানকে দায়ী করেন। যে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বিদিশার সম্পর্ক হচ্ছিল তা পছন্দ করেননি তারেক। তিনিই নাকি তখন এরশাদকে চাপ দিয়ে বিবাব বিচ্ছেদ করান। যেভাবেই হোক তখন এ সিদ্ধান্ত রওশনের পক্ষে গেছে। দৃশ্যপট থেকে বিদিশা অপসারনের পর জাপায় আবার সক্রিয় হন রওশন।

এখন এরিখকে নিয়ে যত গোলমাল, প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশা, এসবের শেষ কোথায়? এসব এরশাদের রেখে যাওয়া বিষয়। জাপার এসব হজম করতে কষ্ট হবে। উগড়ানোও সহজ নয়। এরিখ একটি অটিস্টিক চাইল্ড। সাদের মতো কাগজে কলমের তার বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু মা বেঁচে আছেন। এ নিয়ে আইনি লড়াই চলবে। কিন্তু এর আগে খুনও হয়ে যেতে পারেন বিদিশা। অথবা এরিখ। জাতীয় পার্টি কিন্তু সে রকম একটা পার্টি। এ পার্টির হাতে এখন ক্ষমতা নেই। কিন্তু এরিখের নামে আছে অনেক সম্পত্তি।

fazlulbari2014@gmail.com