তখন সিনেমাঃ আমাদের শৈশবের ঈদের বিনোদন মানেই ছিল সিনেমা

আমাদের শৈশবে ঈদের বিনোদন মানেই ছিল সিনেমা দেখা, আমজাদ হোসেনের জব্বার আলী সিরিজের নাটক, শেষ দৃশ্যে ‘টেকা দেন দুবাই যামু’ বলতে বলতে তাঁর গ্রেফতার হয়ে যাওয়া!

অথবা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, আনিসুল হক বা হানিফ সংকেতের ঈদ আনন্দমেলা,  ইত্যাদি’র বিশেষ অনুষ্ঠান। এই আনিসুল হকই পরে শেখ হাসিনার পছন্দে ঢাকার মেয়র হয়ে অল্প কিছুদিন বেঁচেছিলেন।

আমার শৈশব কেটেছে কুলাউড়ায়। ট্রেনে সিলেটে যাওয়া আসার পথের ধারের একটি জংশন স্টেশন! লিলি, পূবালী নামের দুটি সিনেমা হল তখন ছিল। টিনের চাল, বাঁশের বেড়ার লম্বা ঘর।

ছারপোকা বেশি ছিল। বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের আলো ঢুকতো ভেতরে। বাইরে থেকে শব্দও শোনা যেত। ভিতরের ফ্যানের বাতাস অপর্যাপ্ত থাকায় সিনেমা শেষে আমরা এক রকম ঘর্মাক্ত খালি গায় বেরুতাম।

ঈদ উপলক্ষে নতুন ছবি আসতো লিলি আর পূবালি সিনেমা হলে।  এর আগে রিকশা বা অটোতে করে চলতো মাইকে প্রচারনা! ‘হে ভাই, আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুভ মুক্তি পাচ্ছে—-!’

সকাল দশটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একটার পর একটা শো চলতো ঈদের ছবির!  আমরা সাধারনত সকালের শো’গুলোয় ছবি দেখা সেরে ফেলতাম। কারন দুপুর-বিকেল-রাত পর্যন্ত আমাদের  ঈদের অনেক ব্যস্ত শিডিউল!

আবার আত্মীয়স্বজন সবার বাড়ি ঘুরে ঘুরে সালাম করা, খাওয়াদাওয়াতেও সময় দিতে হয়! এরপর আবার কষ্ট করে দেখতে হয় টিভিতে ঈদের সব অনুষ্ঠান! ঈদের ছবি, নাটক, আনন্দমেলা, ছায়াছন্দ, ইত্যাদি আর কত দেখার সময় করতে হয়।   

আমাদের বন্ধু বুলবুল, নাসির এদের বাসায় সাদাকালো টিভি ছিল। আমাদের শৈশবের বন্ধুদের প্রতিদিনের টিভি দেখা-খাওয়াদাওয়ার মূল ভেন্যুও তাই ছিল এই দু’জনের বাসা।

মাক্কু ভাই, মোজাম্মেল ভাই, ফজলু ভাই, ফয়সল, বুলবুল, নাসির, মুহিত, আশীষ, লাভলু, পারভেজ, দীপক, মন্টু, লীলু, সজল, মৃনাল, কেফায়েত, নইদাসহ আমরা অনেক হরিহর আত্মা।

ঈদ এলেই তাই বুলবুলের আম্মা খালাম্মা, নাসিরের আম্মা খালাম্মা, নীলুর আম্মা খালাম্মা, শাহজাদা ভাবী, জোৎস্না আপাদের খুব করে মনে পড়ে খুব। চোখ ভিজে আসে। তাঁদের অনেকে যে বেঁচে নেই আর।

আর আমাদের শৈশব-কৈশোরের টেলিভিশন মানেই ছিল বিটিভি। আর যাদের বাড়িতে টিভি ছিল, তাদের বাড়ির ছাদ-চালের ওপর এলুমিনিয়ামের পাতিলের ঢাকনা ঝুলতো! সেটিই ছিল এন্টেনা!

আজকের মতো এন্টেনা, ডিশ সংযোগ বা সেটআপ বক্স তখন ছিলোনা। কুলাউড়ার তখনকার ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের বারান্দায় অথবা কলেজেও টিভি দেখার ব্যবস্থা ছিল।

 জিয়াউর রহমানের সময় এলাকায় এলাকায় এই সাদাকালো টিভিগুলো দেয়া হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর পক্ষে শোক সংগঠনে এসব টিভি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

তখন রোজার ঈদের চাঁদ দেখার খবর ঘোষনার পরপরই রেডিও-টিভিতে বাজানো শুরু হয়ে যেত সেই একই বার্ষিক সঙ্গীত! ‘রমজানেরও রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।

ঈদ উপলক্ষে ঈদের দিন, ঈদের দ্বিতীয় দিন, ঈদের তৃতীয় দিন এভাবেই চলতো ঈদের অনুষ্ঠানমালা।  ঈদের বাংলা ছবি মূলত ঈদের দ্বিতীয়, তৃতীয় দিন দুপুরের দিকে দেখানো হতো।

ঈদ উপলক্ষেও টিভিতে দেখানো হতো পুরনো বাংলা সিনেমা। আমজাদ হোসেনের নাটকের জব্বার আলীর চরিত্রটি ছিল বিশেষ স্মরনীয়। ঈদ আনন্দমেলায় গান গাইতেন সাবিনা ইয়াসমিন-রুনা লায়লার মতো শিল্পীরা।

এ ছাড়া ঢাকাই ছবির ঈদের ছবি মানেই ছিল বিশাল কিছু। ঈদে শাবানার ছবি কয়টা, ববিতা-কবরীর ছবি কয়টা এসব ছিল বিশেষ আলোচনা-গবেষনার বিষয়। কাজী জহির, ইবনে মিজানের মতো পরিচালকদের ছবি থাকতো ঈদের বিশেষ আকর্ষন।

ঈদ উপলক্ষে পত্রিকাগুলো বিশেষ ঈদ সংখ্যা বের করতো। বেগম, বিচত্রা, সন্ধানী, রোববার, চিত্রালী, পূর্বানীতো বটে, দৈনিক পত্রিকাগুলোও কলকাতার পত্রিকাগুলোর পুজা সংখ্যার মতো বের করতো বিশেষ ঈদ সংখ্যা।

পনেরো, কুড়ি টাকা থেকে শুরু হতো ঈদ বিশেষ সংখ্যার দাম। বেগমের ঈদ সংখ্যার প্রথম কবিতাটি থাকতো সুফিয়া কামালের। এমন বেশিরভাগ ঈদ সংখ্যায় হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস থাকতো মাস্ট।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমেদ ছফা, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, আমজাদ হোসেন, জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন সহ আরও অনেকে ঈদ সংখ্যার লেখা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন।

চার-পাঁচটা ঈদ সংখ্যায় থাকতো হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস। এগুলোই পরে বইমেলায় বই হিসাবেও বেরুতো। চিত্রালী, পূর্বানী, এমন কি ইত্তেফাকেও ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবির পূর্ন পৃষ্টা বিজ্ঞাপন ছাপা হতো।

সারা দেশের কোথায় কোন ছবি চলছে, কোনটি কী রকম ব্যবসা করছে, এগুলোর সূবর্ন জয়ন্তী, সিলভার জুবিলি, প্লাটিনাম জুবিলি এমন নানাকিছু জানার উপায় ছিল ইত্তেফাকে ছাপা প্রতিদিনের বিজ্ঞাপন!

সিনেমায় রেডিওর বিজ্ঞাপন ছিল আরেক উল্লেখযোগ্য বিষয়। মজার ব্যাপার নাজমুল হুসাইন নামের একজন ব্যক্তিই প্রায় সব ছবির বিজ্ঞাপনে কন্ঠ দিতেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধা ছিলেন এই নাজমুল হোসেন।

আমাদের শৈশব-কৈশোরে আমরা রেডিওতে তাঁর কন্ঠ শুনে শুনেই বড় হয়েছি।  নাজমুল হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে পরিচালক ইবনে মিজানের আগ্রহে তিনি সিনেমার বিজ্ঞাপনে কন্ঠ দিতে শুরু করেন।

তাঁর প্রথম ছবি ছিল ইবনে মিজানের দুই রাজকুমার। ৩০ সেকেন্ডের সেই বিজ্ঞাপন এবং ছবিটি তখন সুপার ডুপার হিট করেছিল। প্রথম দিকে তাঁর উচ্চারনেও সমস্যা ছিল। সংগীতকে বলতেন ‘ছংগীত’! সত্য সাহাকে বলতেন ‘সাত্য শাহা’।

ধীরে ধীরে তিনি এসব উচ্চারনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন। শ্রীলংকার রেডিও সিলনে আমিন সাহানি নামের এক ব্যক্তি মুম্বাই থেকে পনের মিনিটের সিনেমার বিজ্ঞাপনের একটি অনুষ্ঠান করতেন।

আমজাদ হোসেনকে অনুরোধ করে তিনি তাঁর ‘নয়নমনি’ ছবির বিজ্ঞাপনের তেমন একটি স্ক্রিপ্ট দাঁড় করান। ইপসা রেকডিং স্টুডিওতে বিজ্ঞাপনটির রেকডিং হয়। ঢাকায় তখন সেটিই ছিল প্রথম বেসরকারি রেকর্ডিং স্টুডিও।

দুইমাস ধরে বিজ্ঞাপন অনুষ্ঠানটি চললো রেডিওতে। সেই শুরু। সারাদেশে ছবিটির নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এর পরের ছবি দ্য রেইন। পরিচালক এস এম শফি। এবার তিনিই প্রস্তাব দিয়ে নাজমুল হুসাইনকে দিয়ে করালেন দ্য রেইনের বিজ্ঞাপন অনুষ্ঠান।

আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ঢাকার প্রায় সব ছবির বিজ্ঞাপন করতে হয়েছে নাজমুল হুসাইনকে। তখন প্রতি সপ্তাহে দুটি করে ছবি মুক্তি পেতো। এতো কাজের চাপ নিতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল।

তাঁর দেয়া বিজ্ঞাপন উপাধিগুলো পরে অনেক সিনেমা তারকার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যেমন বিউটি কুইন শাবানা, ইন্টারন্যাশনাল টেলেন্ট ববিতা, ড্রিমগার্ল সুচরিতা, সুপার স্টার ফারুক, ডেসিং স্টার সোহেল রানা, মাস্টার মেকার এজে মিন্টু, গোল্ডেন জুবিলি ডিরেক্টর ইবনে মিজান ইত্যাদি।

একমাত্র  ‘নায়করাজ রাজ্জাক’ ছাড়া বাকি প্রায় সব চলচ্চিত্র তারকারই নামের আগের বিশেষণটি নাজমুল হুসাইনের দেওয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় তিনি অভিনয়ও করেছেন।

এখনও আমাদের কানে বাজে আমাদের শৈশব কৈশোরে ঈদের সিনেমার রেডিওর বিজ্ঞাপনে নাজমুল হুসাইনের কন্ঠ—-হে ভাই, এই ঈদে ইন্টারন্যাশনাল টেলেন্ট ববিতা আসছেন গোল্ডেন জুবিলি ডিরেক্টর ইবনে মিজানের ‘এক মুঠো ভাত’ চলচ্চিত্রে! ‘এক মুঠো ভাতের জন্যে’  কিসের কষ্ট নায়িকা ববিতার!”